এক স্বৈরশাসকের উপাখ্যান!

ভবঘুরে আদিবাসী পরিবারে ১৯৪২ সালে সার্তের উপকূলে জন্ম নেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। সেভার স্কুল থেকে বেনগাজীর বিশ্ববিদ্যালয়;ভূগোলের ছাত্র হিসেবে শিক্ষাজীবন শেষ না করেই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে গাদ্দাফির প্রথম আবির্ভাব ১৯৬৯ সালে। নেতৃত্ব দিয়ে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে উল্টে দেন বাদশাহ ইদ্রিসকে। দারিদ্রপীড়িত দেশটির উন্নতির জন্য তৃতীয় বিশ্বের সহযোগিতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন গাদ্দাফি। সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মাঝামাঝি পথ বেছে নেন তিনি। গরিবদের মধ্যে জনপ্রিয় হবে জীবনযাত্রার মান বাড়ান তেল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়িয়ে। আরব জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা হাতে নিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করেন পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে। একইসঙ্গে চেষ্টা চালাতে থাকেন আরব ঐক্য প্রতিষ্ঠায়।

1.এক স্বৈরশাসকের উপাখ্যান!

১৯৭১ সালে আরব ফেডারেশনে অস্থিরতা তৈরি এবং ১৯৭৮ সালে মিশর এবং ইসরাইলের মধ্যে ক্যাম্প-ডেভিড শান্তি চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। আশির দশকে পশ্চিমা বিশেষ করে যুক্তরাষ্টের সঙ্গে গাদ্দাফির সম্পর্কে চির ধরে। মার্কিন মেরিন সেনাদের লক্ষ্য করে ১৯৮৬ সালে বার্লিন ক্লাব উড়িয়ে দিতে যেসব গুপ্তচর পাঠানো হয় সেসব গাদ্দাফির লোক ছিলো বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। তারপরের দিনই যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিমান পাঠায় ত্রিপোলি এবং বেনগাজীতে। সেসময় নিহত হয় গাদ্দাফির এক পালিত কন্যা এবং বিদ্ধস্ত হয় আজিজিয়ায় অবস্থিত গাদ্দাফির বাসভবন। দেশের ভিতরে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে তিনি প্রণয়ন করেন স্থানীয় কংগ্রেস ব্যবস্থার যেখানে আপাতভাবে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারে আপামর জনতা। তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন মনুষ্য নির্মিত সবচেয়ে বড় নদী নির্মাণে। অষ্টম আশ্চর্য আখ্যা দেয়া সেই নদীর পানি দেয়া হয় মরুকূপ থেকে উপকূলের অঞ্চলে। কিন্তু এই ভালোমানুষি উবে যায় ১৯৮৮ সালে।

2.এক স্বৈরশাসকের উপাখ্যান!

লকারবি নামের এক স্কটিশ গ্রামের উপর এক বিশাল (Pan am-103) নামের উড়োযান বোমা হামলায় বিদ্ধস্ত হয়। মারা যায় ২৭০ জন। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা সন্দেহের আঙুল তুলে গাদ্দাফির দিকে। ফলস্বরূপ ১৯৯২ থেকে ৯৩ সালে লিবিয়ার উপরে কঠোর অবরোধ আরোপ করে জাতিসংঘ। কিন্তু তাতে দমে জাননি পুঁজিবাদ ও পশ্চিমাবিরোধী গাদ্দাফি। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার হস্তক্ষেপে গাদ্দাফি বাধ্য হন লকারবি বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত দু’জনকে আইনের হাতে তুলে দিতে। আব্দুল বাসেত আল মেগ্রাই ও আল আমিন খলিফার বিচারকাজ শুরু হয় স্কটিশ আদালতে বিচারে আল মেগ্রাই দোষী সাব্যস্ত হন এবং স্কটিশ আদালত তাকে ২৭ বছরের কারাদন্ড দেয়। মুক্তি দেয়া হয় খলিফাকে।

3.এক স্বৈরশাসকের উপাখ্যান!

কল্পনাবিলাসী বলুন অথবা একনায়ক গাদ্দাফির কিছু অভ্যাস নজর কাড়ে সকলের। সেনা ব্যারাকে তাবুর ভেতরে সাধারণ সেনার মতো জীবনযাপন বিদেশযাত্রায় গেলেও বগলদাবা করতেন তাবু। একবার কায়রোর প্রেসিডেন্সিয়াল কম্পাউন্ডের ভিতরেই তাবু গাড়েন তিনি। আর সঙ্গে নারী দেহরক্ষী তো ছিলোই। গাদ্দাফি সবসময়ই কঠোর সমালোচনায় ছিলেন ওস্তাদ। নিজের জ্ঞাতী ভাইদেরও ছেড়ে কথা বলেন নি। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন সেনাদের খেদমত করায় ২০০৩ সালে সৌদি আরবকে বেশ কড়া কথা বলেন তিনি। সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ খেপে গিয়ে বলেন, তাকে ক্ষমতায় কে এনেছে। ২০০৩ সালে ত্রিপোলী হঠাৎ করেই ঘোষণা দেয় তারা ব্যাপক বিদ্ধংসী অস্ত্র পরিহার করবে এবং তাদের পরমাণু স্থাপনা ঘুরে দেখার অনুমতি দেবে জাতিসংঘকে।

4.এক স্বৈরশাসকের উপাখ্যান!

গাদ্দাফির এমন ঘোষণায় পশ্চিমা বিশ্ব কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয় লিবিয়ার।২০০৪ সালে লিবিয়া সফরে আসে তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। পরের দু’বছরে পর্যায়ক্রমে যুক্তরাষ্ট্র উঠিয়ে নেয় বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এবং সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকা থেকে নাম উঠে যায় লিবিয়ার। অন্যান্য রাষ্টের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে শুরু করে কূটনৈতিক সম্পর্ক। ২০০৯ সালে গাদ্দাফি প্রথমবারের মতো সফরে যান তাদের সাবেক উপনিবেশিক শাসকদের দেশ ইতালিতে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বার্লুস্কনি উষ্ণ সংবর্ধনা জানান তাকে। পরের বছর আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে গাদ্দাফি আবারো আসেন ইতালিতে G-8 সম্মেলনে অংশ নিতে। সেখানেই তার সঙ্গে সাক্ষাত হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার। লিবিয়ায় ফিরে গাদ্দাফি স্বাগত জানান লকারবি বিমান হামলার প্রধান ও একমাত্র আসামী আল মেগ্রাইকে।

5.এক স্বৈরশাসকের উপাখ্যান!

বিষয়টি কঠোর সমালোচিত হয় সারা বিশ্বে। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে ধুমধাম করেই ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে নিজের ক্ষমতার ৪০ বছর পূর্তি পালন করেন ৬ দিন ধরে। সেখানে হাজির ছিলেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শেভিজ। বিশ্ব রাজনীতির এই মেরুকরণ চোখ এড়ায়নি অনেকেরই। বিষয়টি প্রকট হয় পরের মাসেই। গাদ্দাফি যখন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং জাতিসংঘের সাধারণ সভায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে সামন্তবাদী বলেন। তিনি এসময় থাই সেনাদের ক্ষমতা ব্যবহারের কথা উঠিয়ে বলেন নিরাপত্তা পরিষদকে সন্ত্রাস পরিষদ বলাই ভালো। তিউনিশিয়া মিশরের গণবিক্ষোভের ঢেউ আঁচড়ে পড়ে লিবিয়ার মাটিতে।

6.এক স্বৈরশাসকের উপাখ্যান!

শুরু হয় বিদ্রোহ। তাদের দাবি গাদ্দাফিকে ছাড়তে হবে ৪০ বছরের ক্ষমতা। রাজি না হওয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। তাদের দমাতে গাদ্দাফি ব্যবহার করেন যুদ্ধবিমান। বিদ্রোহীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে লিবিয়ার আকাশকে নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করে জাতিসংঘ। দুই দিন পরেই বেসামরিক লোকদের রক্ষা করার আওয়াজ তুলে যৌথভাবে লিবিয়ায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও কানাডা। ওডিসি ডোন নামের ঐ অভিযান এবং বিদ্রোহীদের সমন্বিত হামলায় পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে গাদ্দাফি ও তার বাহিনী। ঘনিষ্ঠরা ত্যাগ করে তাকে এবং হামলায় মারা যায় গাদ্দাফির ছেলে, নাতিসহ অনেকে। গাদ্দাফির পতনের সঙ্গে সঙ্গে লিবিয়ায় উদ্ভব হয় নতুন গণতন্ত্রের।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)