কালিগঞ্জে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন সম্পর্কিত এক স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান : প্রধান অতিথি শাহারিয়ার কবির
২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৩ সালের ২০জুন কালিগঞ্জের বিশ্বানাথপুর গ্রামের সরকার পরিবারের জমি জবরদখল করতে তারালী ইউপি চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা আব্দুল গফুরের নেতৃত্বে মন্দির ভেঙে আগুন দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ বিঘা জমি দখল করে বানানো হয়েছিল খেলার মাঠ। বাধা দেওয়ায় ধীরেন্দ্র নাথ সরকার, নরেন্দ্র নাথ সরকার, সুরেন্দ্র নাথ সরকার, বীরেন্দ্র নাথ সরকার, রবীন্দ্র নাথ সরকার , তাদের স্ত্রী আদুরি, বনলতাসহ কয়েকজনকে পিটিয়ে জখম করা হয়। ওই পরিবারের এক গৃহবধূকে উপর্যুপরি নির্যাতন করে ধর্ষণ করা হয়েছিল। সম্ভ্রম বাচাতে ওই নারী অত্যাচারী জামায়াত নেতাদের পায়ে ধরেছিলেন। ধরম বাপ ডেকেছিলেন। এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তার দেখে বলেছিলেন এ ধরণের অত্যাচার মেনে নেওয়া যায় না। অথচ ওই ডাক্তার যখন ডাক্তারি সনদ পত্র দিয়েছিলেন তখন ধর্ষণের আলামত মেলেনি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালী ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের হরি মন্দিরের সামনে আয়োজিত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন সম্পর্কিত এক স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহারিয়ার কবির এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ২০০১ সালের ২২ নভেম্বর তাকে জেলে পাঠানো হয়। এসময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসামী ছিল সাত হাজার। দু’ মাস পর যখন তিনি জেল থেকে বের হন তখন আসামী ছিল ১৩ হাজার। যার ৯২ শতাংশই ছিল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী। তাদের জেলে বাইরে ও ভেতরে যেভাবে মেরে হাত পা’ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল তাদের চিৎকার ও যন্ত্রণায় রাতে ঘুমোতে পারতেন না তিনি। অথচ সে দিনের অত্যাচারীরা এখন গায়েবী মামলায় তাদের লোকজনকে ধরে জেলে পাঠানো হচ্ছে বলে চিৎকার করছেন। বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে ফাতেমা বলে এক গৃহপরিচারিকাকে রাখতে দিয়ে জেল কোড আইন ভঙ্গ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
শাহারিয়ার কবীর বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী খুলনার সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু, হুমায়ুন আজাদসহ ১৬ জন সাংবাদিক ও কলামিস্টকে হত্যা করেছিলো মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামায়াত ও শিবির। তারা তো আর আওয়ামী লীগ করতেন না। স্বাধীনতা পরবর্তী ২৪ বছর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বাংলাদেশে শোষণ ও শাসন করাটা দুঃখের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা ও জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছিল। হত্যাকারীদের প্রধান ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে এসব ঘটনায় আত্মস্বীকৃত কয়েকজনের বিচার হলেও আইএসআই এর প্রধান প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও সিআই এর গুপ্তচরদের শাস্তি হয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ১০ হাজার ঘটনায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল। সংখ্যালঘু হওয়া ও নৌকায় ভোট দেওয়ার কারণে তাদের উপর নির্যাতন করা হয় বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়। সিরাজগঞ্জে পূর্ণিমাকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল তা সংবাদ সম্মেলন করার সময় বিবিসি’র নারী সাংবাদিক শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। নির্যাতিতদের অনেকেই মামলা করেত পারেনি। আবার মামলা করলেও তুলে নিতে হয়েছে জামায়াত নেতাদের হুমকিতে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি পরবর্তী সময়ে রামু, নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাঠ হয়েছিল। হামলাকারী জামায়াত শিবিরের লোকজন আওয়ামী লীগের ঘাড়ে ভর করে এসব সহিংসতা করেছিল। জামায়াত ইসলামের সংবিধানে শুধু মাত্র মুসলমান ছাড়া কোন হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তি সদস্য হতে পারবে না। যেটা বাংলাদেশর সংবিধানের পরিপন্থী, যে কারণে তাদের সংবিধান বাতিল হয়ে নির্বাচন করতে পারছে না। আজ সেই জামায়াত বি,এন,পির ঐক্যে ডাঃ কামাল হোসেন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ডাঃ কামাল হোসেন ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি সংবিধানে রেখে সংবিধান রচনা করেছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে হত্যা সম্পর্কিত কমিশনের সদস্য হিসেবে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন এ দায় বর্তমান সরকারের। অথচ সেই কামাল হোসেন বিএনপি জামায়াতের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্যফ্রন্টর নেতৃত্ব দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সময় বাংলাদেশে ৮.৬ শতাংশ হিন্দু বসবাস করেছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন বর্তমানে এ দেশে হিন্দুদের বসবাসের সংখ্যা ১০.২ শতাংশ। ভারতে চলে যাওয়া অনেক হিন্দুই দেশে ফিরে এসেছে এবং এদেশ থেকে কোন হিন্দুই এখন ভারতে যাচ্ছে না ফলে দেশে হিন্দুর সংখ্যা বাড়ছে এটা একটি মানবাধিকার সূচক বলে দাবি করেন তিনি। ১২ থেকে ৪৮ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট আছে এমন ৯৬টি কেন্দ্রে তারা ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে ৫৮টি কেন্দ্রে নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সহিংসতা প্রতিরোধে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বিশেষ কমিটি গঠন করবে। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু সরকার নয় এলাকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে এজন্য কাজ করতে হবে। ২০০১ সালে ও ২০১৪ সালে নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হয়েছিল। আগামীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না গেলে ওই অত্যাচার কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে সকলকে সতর্ক করে তিনি বলেন, জামায়াত , মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ও হাইব্রীড আওয়ামী লীগারদের আগামী সংসদীয় নির্বাচনে ভোট না দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান শাহারিয়ার কবির। সহিংসতা প্রতিরোধে পাড়ায় পাড়ায় ও মহল্লায় মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেন তিনি।
তারালী ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হোসেন ছোট’র সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির খুলনা অঞ্চলের সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ আশেক এলাহী, শ্যামনগর উপজেলা হিনউ বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি জয়দেব বিশ্বাস, নির্যাতিত ধীরেন্দ্র নাথ সরকার প্রমুখ। স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে শাহারিয়ার কবীর সরকার পরিবারের নির্যাতিত ১০জন নারী ও পুরুষের হাতে বস্ত্র তুলে দেন। পরে তিনি নির্যাতিতদের বাড়িতে যেয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্যরা ।