যা বলে ভোট চাইবে বিএনপি…
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ধানের শীষের পক্ষে জোয়ার উঠেছে।’ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই বিএনপির নেতাদের বক্তব্য অনেকটা এমনই। নেতৃবৃন্দরা বলছেন, ‘এবারের নির্বাচন বিএনপির জন্যে একটা সুবর্ণ সুযোগ। দেশের জনগণ ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্যে মুখিয়ে হয়ে আছে।’ কিন্তু জনগণ যতই মুখিয়ে থাকুক ভোট চাওয়ার জন্যে জনগণের কাছে যেতে হবে এবং জনগণের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য তুলে ধরে ভোট চাইতে হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জনগণের কাছে কি বক্তব্য নিয়ে যাবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এবং সাধারণ মানুষের ব্যাপক কৌতূহল আছে। তিন বছর আগে বিএনপি বলেছিল তারা সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রদান করবে। তবে সেই রূপরেখা আলোর মুখ দেখেনি। সে রূপরেখা ছাড়াই বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার সম্পর্কে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক সচেতন মহল জানে না। তারপরও অনুমান করা যাচ্ছে যে, বিএনপি কিছু মুখরোচক বক্তব্য এবং সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়ে ভোটারদের কাছে যাবে।
বিএনপি আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৫টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ভোটের মাঠে নির্বাচনী প্রচারণা চালাবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। বিষয়গুলো হলো:
১. খালেদা জিয়ার মুক্তি: বিএনপির নির্বাচনী মাঠে যে কথাগুলো তুলে ধরবে জনগণের কাছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান এবং প্রথম ইস্যু হলো বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। বিএনপি কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছে, তারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে। আপনার একটি ভোটই, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারে, এই শ্লোগানকেই বিএনপি ভোটের মাঠে জনপ্রিয় করতে চায়। এই নির্বাচনে কোন আসনে কে প্রার্থী, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়ার থেকে বিএনপি এই নির্বাচনকে গণভোটে রূপান্তরিত করতে চায়। যে গণভোটে বিএনপি জয়যুক্ত হবে।
২. বর্তমান সরকারের দুর্নীতি: বিএনপির এবারের নির্বাচনের মাঠে দ্বিতীয় ইস্যু হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের দুর্নীতি এবং অনিয়ম। ভোটের মাঠে প্রচারণায় এবং ভোট চাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করাই হবে বিএনপির অন্যতম একটি কৌশল। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ, সন্ত্রাস এবং অনিয়মের অভিযোগগুলো তুলে ধরবে। বিএনপির একটি নির্বাচনী সেল এ বিষয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে। বিগত ১০ বছরে প্রধান প্রধান দুর্নীতি, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে যে দুর্নীতিগুলো হয়েছে এবং গণমাধ্যমে ব্যাংকের দুর্নীতির যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তার তথ্য এবং উপাত্ত সংগ্রহ করছে বিএনপি। ব্যাংকের দুর্নীতিগুলো বিষয়ে ভোটের মাঠে জনগণের কাছে তুলে ধরে সরকারকে নাজেহাল করার চেষ্টা করবে তারা।
৩. গুম, খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন: গত পাঁচ বছর ধরেই বিএনপি অভিযোগ করে আসছে, এই সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, গুম খুনের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর দমন পীড়ন চালিয়েছে। শুধু দেশেই নয় তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিভিন্ন লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছিল এবং তাদের দিয়ে দেশে-বিদেশে সরকার বিরোধী নানা প্রচারণায় নেমেছিল। ভোটের মাঠে বিএনপি গুম, খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে অন্যতম ইস্যু করে প্রচারণা চালাবে। বিশেষ করে যে সমস্ত অঞ্চলে বিএনপির নেতাকর্মীরা নিখোঁজ হয়েছেন, সেই সমস্ত এলাকায় গুম এবং নিখোঁজের বিষয়টাকে সামনে নিয়ে আসবে। যেমন সিলেট অঞ্চলে ইলিয়াস আলীর ইস্যুই হবে তাদের মূল ইস্যু। এভাবে যেসব এলাকায় গুম, নিখোঁজ বা আটকের অভিযোগ রয়েছে, সেসব এলাকায় গুম, নিখোঁজ বা আটকের ইস্যুকে তুলে ধরে, জনগণের মাঝে আবেগ সৃষ্টি করে ভোটের মাঠ দখলের চেষ্টা করবে বিএনপি।
৪. প্রতিহিংসা নয়, নতুন প্রত্যয়: ভোটের মাঠে প্রতিহিংসা নয়, নতুন প্রত্যয় এই স্লোগানটি বিএনপি ইতিমধ্যে তৈরি করেছে। বিএনপি ভোটের মাঠে নির্বাচনী প্রচারণার কৌশল হিসেবে এই স্লোগানটি ঠিক করেছে। কারণ নির্বাচন এলেই মানুষের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করে যে, নির্বাচনে যদি সরকার পরিবর্তন হয় তাহলে, একটি পক্ষের উপর আক্রমণ হবে। ২০০১ সালের অভিজ্ঞতা জনগণের কাছে প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, দলীয় নেতাকর্মীদের উপর হত্যা-সন্ত্রাস এবং নির্বিচারে নির্যাতন ভুক্তভোগীদের কাছে বিভীষিকাময় স্মৃতি হয়ে জ্বলজ্বল করছে এখনো। বিএনপি তার নির্বাচনী প্রচারণায় এই বিষয়ে গুরুত্ব প্রধান করতে চায়। বিএনপি তার নির্বাচনী প্রচারণার বক্তব্যে বলবে, বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। বিএনপি যদি জয়যুক্ত হয় তাহলে তারা কোনো ধরনের প্রতিহিংসা করবে না। প্রতিহিংসা রাজনীতি করবে না বলতে তাঁরা প্রতিপক্ষ এবং সংখ্যালঘুদের বোঝাবে।
৫. সংখ্যালঘুদের দৃষ্টি আকর্ষণ: এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি সংখ্যালঘুদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাবে। বিএনপি মনে করে তাঁরা প্রতিবার নির্বাচনী প্রচারণায় সংখ্যালঘুদের কারণে পিছিয়ে পড়ে এবং আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট। নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিএনপি নানা রকম প্রচারণার কৌশল গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবচেয়ে নিরাপদে থাকবে বিএনপি ক্ষমতায় এলে। সংখ্যালঘুদের দেখভাল করা হবে এবং তাদের উপর কোনো ধরনের নিপীড়ন করা যাবে না।’ কারণ তথ্য ও উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে ৯১ সালের পর থেকে বিএনপি দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে সংখ্যালঘুদের উপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না এই অঙ্গীকার করে তাঁরা ভোটের মাঠে জনগণের কাছে ভোট চাইবে বলে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।