বাংলাদেশের উপজাতি ও বৌদ্ধধর্ম
বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠি এবং তাদের আচার ও ধর্ম নিয়ে লেখার দ্বিতীয় কিস্তি দেয়া হলো। এবারের বিষয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর উপজাতি মারমা।
মারমা
বাংলাদেশের একটি আদিবাসী ও বৃহৎ জাতিসত্ত্বা। তিন পার্বত্য জেলায় তাদের বসবাস দেখা গেলেও মূল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের বসবাস বান্দরবানে। ‘মারমা’ শব্দটি এসেছে ‘ম্রাইমা’ থেকে। মারমারা মিয়ানমার থেকে এসেছে বিধায় তাদের ‘ম্রাইমা’ নাম থেকে নিজেদের ‘মারমা’ নামে ভূষিত করে। মারমারা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কথা বলার ক্ষেত্রে মারমাদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও লেখার ক্ষেত্রে তারা বার্মিজ বর্ণমালা ব্যবহার করে। মারমা সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। পুরুষদের মতো মেয়েরাও পৈতৃক সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকারী হয়। ভাত মারমাদের প্রধান খাদ্য। পাংখুং, জাইক, কাপ্যা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মারমা সমাজে জনপ্রিয়।
জনসংখ্যা: বান্দরবানে মারমা লোকসংখ্যা প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার। শিক্ষাদীক্ষা ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মারমারা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশে চাকমার পর মারমা দ্বিতীয় বৃহত্তর উপজাতি জনগোষ্ঠী (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী)।
ধর্মীয় উৎসব:
মারমাদের প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসব বৌদ্ধ পূর্ণিমা, কঠিন চিবর দান ও ওয়াহ্গ্যই বা প্রবারণা পূর্ণিমা ।
বৌদ্ধ পূর্ণিমা: এই পূর্ণিমা তিথীতে মহামতি গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। এটি একটি ধর্মীয় উৎসব।
কঠিন চীবর দান: তুলা থেকে সুতা তৈরী করে তা রং করে এক রাতেই বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের পরিধানের চীবর তৈরী করা হয় বলে একে কঠিন চীবর বলে।
ওয়াহ্গ্যই: ওয়াহ্গ্যই বা প্রবারণা পূর্ণিমা হলো মারমাদের একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এই দিন মারমাদের প্রতিটি সমাজ ও বিহারে এই উৎসবটি অতি আনন্দ ও খুশির সঙ্গে পালন করা হয় । এই দিন ঘরে ঘরে সুস্বাদু পিঠা তৈরী করা হয় । রাত্রে বেলায় এই দিনে মারমারা গৌতম বৌদ্ধের মহা চুলকে পূজা ও উৎসর্গ করার জন্য ফানুসবাতি উড়ানো হয়।
সামাজিক উৎসব
সাংগ্রাই:
সাংগ্রাইয়ের তাৎপর্য: পৃথিবীর সকল জাতির মতো মারমারা ইংরেজি ক্যালেন্ডার ছাড়াও নিজস্ব একটা ক্যালেন্ডারকে অনুসরণ করে এবং তা বর্মী ক্যালেন্ডার অনুসরণ করেই করা হয়। মারমাদের বর্ষপঞ্জিকাকে “ম্রাইমা সাক্রঃয়” বলা হয়। “ম্রাইমা সাক্রঃয়” এর পুরনো বছরের শেষের দুই দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনসহ মোট তিনদিন মারমারা সাংগ্রাই হিসেবে পালন করে থাকে। আগে “ম্রাইমা সাক্রঃয়” অনুযায়ী এই তিনদিন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের এপ্রিল মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে পালন করা হয়। ১৩ তারিখের সকালে পাঃংছোয়াই (ফুল সাংগ্রাই), ১৪ তারিখে প্রধান সাংগ্রাই আর ১৫ তারিখে পানি খেলার সঙ্গে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোও অনুষ্ঠিত হয়।
সাংগ্রাই এর প্রধান আকর্ষন হল পানি খেলা যেটিকে মারমারা বলে “ড়ি লং পোয়ে”। সাংগ্রাইয়ের পানি খেলা শুধুমাত্র মারমাদের নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া আর চীনের দাই জাতিগোষ্ঠীরাও এপ্রিলের মাঝামাঝিতে এই ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকে। মায়নামারে এই ধরনের অনুষ্ঠানকে “থিনগন” আর থাইল্যান্ড ও লাওসে এই অনুষ্ঠানকে “সংক্রান” বলে। থাই ভাষায় “সংক্রান” এর অর্থ হল পরিবর্তন। সাংগ্রাই আসলেই পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়াকেই বোঝায়। সেই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে নতুন জুম চাষের মৌসুমের শুরুও সাংগ্রাই-এর পরেই হয়ে থাকে।
শুধু জুম চাষই নয় মারমারা মাঘী পূর্ণিমার পর থেকে সাংগ্রাই এর আগ পর্যন্ত নতুন বিয়েই করে না। অর্থাৎ সাংগ্রাইকে নতুন বছরের শুরুসহ পুরনো সব জিনিসকে ঝেরে ফেলে নতুন করে শুরু করাকেই বোঝায়। আর তাই মারমারা এক আনন্দঘন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আর্শীবাদ আর শুভাকাঙ্কার আশায় নতুন বছর উদযাপন করে থাকে। এতে মারমাদের ঐতিহ্যগুলোকে নানাভাবে তুলে ধরা হয়। সাংগ্রাই নৃত্য সহ আরো নানা ধরনের নৃত্য এতে পরিবেশন করা হয়। এছাড়া মারমা গুনী শিল্পীরা এতে অংশগ্রনণ করে বিভিন্ন মারমা গান পরিবেশন করা হয়। বর্তমান দিনে মারমা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরই কনসার্টের আয়োজন করা হয়। এই মারমা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর কনসার্টকে নিয়ে মারমা তরূণ-তরূণীরা তাদের নতুন “ম্রাইমা সাক্রয়” কে বরন করে নেয়।