কেমন ছিল প্রাচীন খাবার?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনধারণের পাশাপাশি খাবারেও এসেছে হরেক পরিবর্তন। আমরা যা খাই, তার রেসিপি কিংবা রন্ধনশৈলী সম্পর্কে কতটা জানি? প্রাচীনকালে মানুষের কাছে আজকের মতো এত সুবিধা ছিল না। তবুও আমরা পেয়েছি বিরিয়ানীর মতো অনেক সময়সাপেক্ষ এবং বাহারী খাবারের রেসিপি। এর চেয়েও অনেক আগে যাওয়া যাক। প্রাচীন কিছু খাবারের রেসিপি ও সেগুলোর সম্পর্কে কিছু জানাতেই আজকের আয়োজন-
দ্য ফর্ম অব কারি (এডি- ১৩৯০):
১৪শ শতকের একটিখাবার একবিংশ শতাব্দীতে এসে চেখে দেখতে কেমন লাগবে? যখন জানবেন এই খাবারটি রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড খেয়ে গিয়েছিলেন, কেমন বোধ হবে মনের মাঝে? নিজের মাঝে রাজকীয় ভাব চলে আসাটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? রিচার্ডের ব্যক্তিগত রাঁধুনিরা এই বইটি প্রস্তুত করেছিল এবং এই বইতে যেসব খাবারের রেসিপি রয়েছে, তা রাঁধা হতো কেবল রাজার জন্যই। সাধারণ মানের খাবার থেকে অত্যন্ত জটিল, মোট ১৯০টির মতো রেসিপির সন্ধান দেয়া আছে এই বইতে। কিছু কিছু খাবার কেবল গরম পানি এবং তেলে আদা মিশিয়ে তৈরি করা হতো, আবার কিছু কিছু খাবার সুস্বাদু করে তুলতে প্রয়োজন হতো তিমির মাংস! রাইল্যান্ডসের ক্যাফেতে ২০০৯ সালের দিকে এমন কিছু রেসিপি সেখানে খেতে আসা অতিথিদের জন্য রাখা হতো। তবে আপনি চাইলে পয়সা খরচ করে বইটি কিনতে হবে না। ডাউনলোড করে নিতে পারবেন বিনামূল্যেই।
অ্যান্নালস অব দ্য কালিফ’স কিচেন (এডি- ১০০০):
অ্যান্নালস অব দ্য কালিফ’স কিচেন বা খলিফার হেঁশেলের বিস্তারিত কথা নামক এই বইটি লিখেছিলেন আল ওয়ারাক নামক একজন আরবীয়। জানামতে, আরবী ভাষায় রচিত এটিই সবচেয়ে প্রাচীন রন্ধনবিদ্যার ওপর লিখিত বই। বইটিতে প্রায় ৬০০টির মতো ভিন্ন ভিন্ন রেসিপি দেয়া আছে এবং তাদের স্বাদ ও মান আজকের যেকোনো খাবারের তুলনায় অনন্য। কিছু কিছু খাবার প্রস্তুত প্রক্রিয়ার কথা না বললেই নয়। একটি সস তৈরির জন্য রাঁধুনিকে সূর্যের আলোয় অন্তত ৫০দিন রাখার কথা বলা আছে এই বইতে! এছাড়াও সংস্কৃতি, মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা টিপস- ইত্যাদিও দেয়া আছে এখানে। মাথা ধরলে কিংবা পেট ব্যথা করলে ‘কিশকিয়া’ নামক একটি খাবারের কথা বলা আছে, যেটি সকালে ঘুম থেকে উঠে খেতে হয়। পান করার আগে বাঁধাকপি খেয়ে নেয়ার কথাও বলা আছে। অনলাইনে কিশকিয়া তৈরির রেসিপি সহজেই পেয়ে যাবেন।
আপিসিয়াস (এডি- ৫০০):
এক রোমান রাজা তার নিত্যদিনের পানাহারে কী খেতেন, সেটি জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে আপিসিয়াস নামক এই বইটি। ধারণা করা হয়, বইটি লিখেছেন মার্কাস গ্যাভিয়াস আপিসিয়াস নামক এক রোমান শেফ। বইটি ঠিক কবে লেখা হয়, তা নিয়ে সঠিক কোনো ধারণা নেই, তবে অন্তত ১ হাজার ৫০০ বছর আগে বইটি লেখা হয়েছে, এটুকু বলা যায়। মাংস কেমন করে রান্না করতে হয়, তার কিছু চমৎকার বর্ণনা দেয়া আছে বইটিতে। প্রায় ৫০০ এর মতো রেসিপি দেয়া আছে এবং ৪০০ টিরও অধিক খাবারের তৈরি প্রক্রিয়ার কথাও বলা আছে। পুরো বইটি অনলাইনে রয়েছে তবে আধুনিককালে বইটি নতুনভাবে সংস্কার করতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যাতেই পড়তে হয়েছে বৈকি। অতি দক্ষ রোমান শেফরাই কেবল এই বইটির রেসিপি সম্পর্কে ভালোভাবে জানত, তাই কতটুকু উপাদান কী পরিমাণে দিতে হবে, তা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলা নেই। আপেলের সঙ্গে পর্ক কীভাবে রাঁধতে হয়, তা নিয়ে একটি রেসিপি আধুনিককালে তৈরি করেছে দ্য সিল্ক রোড গরমেট।
গারুম (৬০০-৮০০ বিসি):
গারুম হচ্ছে লবণাক্ত একটি মাছের ডিশ। এখানে এমন একটি ডিশ রয়েছে, যেখানে যতটুকু মাছ আপনি রাঁধবেন, ঠিক ততটুকুই লবণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিছু কিছু রেসিপির কথা খুব পরিষ্কারভাবে লেখা নেই। তবে লরা কেলি নামক এক প্রাচীন রন্ধন বিশেষজ্ঞ কিছু অংশের পরিষ্কার উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। যীশু জন্মের ৬০০ থেকে ৮০০ বছর আগে কার্থাজিনিয়ান সস নামক একটি সস তৈরি করা হতো। এখানে সে সস তৈরির রেসিপি দেয়া আছে। কেলি তা নতুন করে তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। আপনি তৈরি করতে চাইলে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে কারণ এটি অনেক প্রাচীন একটি প্রক্রিয়া। কেলির মতে, এই সস তৈরির জন্য গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কখনো0 কখনো নয় মাসও অপেক্ষা করতে হয়!
সুমেরিয়ান মদ (১৮০০ বিসি):
সুমেরীয় এই মদ আদতে কোনো রেসিপি নয়। মদের দেবী নিনকাসির উদ্দেশ্যে একটি কবিতা রচনা করা হয়েছিল। এই কবিতার ভাবার্থ উদ্ধার করতে গেলে একটু বিষম খেতে হয়। কারণ, এখানে নিনকাসিকে যেসব কথা বলে নৈবেদ্য প্রদানের কথা বলা হয়েছে, তা যদি কেউ অনুসরণ করে, তাহলে খুব চমৎকার ও সুস্বাদু মদ তৈরি হয়। স্ট্র এর সাহায্যে এই মদটি খেতে হয় এবং স্বাদ কড়া আপেলের নির্যাসের মতো। তবে একটি কথা মনে রাখা জরুরি। তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই এটি পান করতে হবে। তা না হলে মদটি হারাবে তার স্বাদ ও কার্যকারিতা।
কাবাব (১৭০০ বিসি):
কাবাবের স্বাদ অনেকেই পছন্দ করেন না। তবে প্রাচীন যত খাবার রয়েছে, তার মাঝে কাবাবের নামটি এসে যায় অনায়াসেই। বিশ্বের নানা দেশে নানা রকমফেরে কাবার তৈরি করা হয়। তবে প্রাচীন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তার কিছুরই হয়ত মিল নেই। যীশু জন্মের অন্তত ১ হাজার ৭০০ বছর আগে গ্রীসের মানুষ কাবাব খেত, তার কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে (এখন থেকে যখনই আপনি কাবাব খাবেন, মনে করবেন অন্তত ৪ হাজার বছর আগে তৈরি হওয়া একটি খাবারের রেসিপি পেয়েছেন!) এমনকি চুয়ান নামক যে চাইনিজ কাবাব রয়েছে, সেটিও গ্রীক রেসিপি থেকে প্রভাবিত। ধারণা করা হয়, চৈনিকরা গ্রীকদের অনেক রেসিপি নিজেদের রেসিপির সঙ্গে মিলিয়ে নতুন খাবার তৈরির চেষ্টা করেছিল।
মিডাস টাচ বিয়ার (৭০০ বিসি):
মিডাসের গল্প তো আমাদের সকলেরই জানা আছে, তাই না? সেই যে এক রাজা ছিল, যার হাতের স্পর্শে সব স্বর্ণ হয়ে যেত? তবে মিডাস নামক এক রাজা কিন্তু সত্যিই ছিলেন। তার মৃত্যুর ২ হাজার ৭০০ বছর পর সমাধির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। সেখানে কোনো স্বর্ণ ছিল না। এমনকি তার সমাধিতে পাওয়া সবকিছুই ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি। তবে জীবদ্দশায় অত্যন্ত আকর্ষণীয় একধরনের মদ পান করতেন মিডাস। তার বিয়ারের গ্লাসের রাসায়নিক পরীক্ষা করে সে সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। সেটি নতুন করে তৈরি করার প্রক্রিয়াও এখন আমরা জানি। ওয়াইন, মদ, মিড (পানি, মধু ও নানা ধরনের ফলের নির্যাসের সাহায্যে তৈরি এ ধরনের পানীয়) এর সাহায্যে মিডাস তার পানীয় তৈরি করতেন। এটি তৈরি করতে চাইলে করতে পারেন তবে ‘দ্য ডগফিশ ব্রিউয়ারি’ নামক প্রতিষ্ঠানটি সারাবিশ্বে ‘মিডাসের স্পর্শ’ নামক এই বিয়ারটি বাজারজাত করছে। অবশ্যই সেটি প্রাচীনকালের পানীয়ের মতো হবে না, তবে চাইলে আপনি চেখে দেখতেই পারেন মিডাসের চমৎকার একটি রেসিপি। তার জন্য পকেটেও পয়সা থাকা চাই!