পতিতা থেকে জলদস্যু
কুখ্যাত জলদস্যু ব্ল্যাকবিয়ার্ড কিংবা হেনরি মরগানের কাহিনী অনেকেরই জানা। প্রায় দশটির মতো জাহাজ এবং প্রায় কয়েক শত জলদস্যু নিয়ে সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াতো তারা। কিন্তু তাদের কাহিনী সর্বকালের সবচেয়ে সফল জলদস্যুর কাহিনীর কাছে ম্লান হয়ে যায়। শিং শিহ বা শেং আই সাওয়ের দখলে প্রায় আঠারোশো জাহাজ ছিল এবং অার ছিল প্রভাবশালী ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, শিন সাম্রাজ্যের শত্রুতা, তারপরেও তিনি শেষ বয়স পর্যন্ত বেঁচেছেন!
যৌবনের প্রথমদিকে খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন শেং। চীনের বন্দরনগরী গুয়াংজুতে ভাসমান পতিতালয়ে দিন কাটত তার। ১৮০১ সালে জলদস্যু সর্দার শেওং তাকে বিয়ে করে। এই দস্যু দম্পতির তৈরি করা দল পরিণত হয় পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ জলদস্যু দলে। তাদের দখলে প্রায় একশ‘র বেশি জাহাজ, শত শত নৌকা এবং প্রায় ৫০ হাজার জলদস্যু ছিল। ১৮০৭ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন শেং সাও। দক্ষ কৌশলের মাধ্যমে শেং মৃত স্বামীর দলের ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
কড়া সামরিক আইন সঙ্গে কিছু অবাক করা ‘কোড অব ল’ চালু করে নিজ নেতৃত্বকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন। নারী ভিকটিমরা যখন ধরা পড়তো তখন তাদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারত দস্যুরা। কিন্তু ভিকটিমদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে দস্যুদের আর রেহাই ছিল না। শেং এর নেতৃত্বে তার দস্যু দল অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে; দুইশত কামান এবং তেরশো বন্দুকে সজ্জিত ছিল শুধু রেড ফ্ল্যাগ নৌবহর। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে তারা গুয়াংজু প্রদেশের ১৩৫টি সামরিক রণতরীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি রণতরী ধ্বংস করে। বাধ্য হয়ে চীনা নৌ-বাহিনী বহিঃশক্তির আশ্রয় নেন।
শেং সাওকে তারা এতটাই ভয় করত যে আসন্ন যুদ্ধের ইঙ্গিত পেয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের জাহাজ ধ্বংস করে ফেলত। তাদের ডাকাতির হাত থেকে বাদ যেত না কিছুই। মাছ ধরার নৌকা থেকে শুরু করে পণ্যবাহী জাহাজ সবকিছুই লুট করে নিয়ে যেত শেং সাওয়ের বাহিনী। তারা বিদেশি জাহাজে ডাকাতি এবং অপহরণ করেও মুক্তিপণ আদায় করত। শাসক হিসেবেও অত্যন্ত ধুরন্ধর এই মহিলা বন্দর তীরবর্তী গ্রামে-গ্রামে ব্যাংক স্থাপন করে জলে ও স্থলে জনগণের সুরক্ষা বাবদ অর্থ আদায় করতেন তার জলদস্যুদের দিয়ে। এর ফলে রাজ্যের মধ্যেই আরেকটি রাজ্যের রাজত্ব করতে থাকেন শেং সাও, যার প্রভাব দক্ষিণ চীন সাগর পেরিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল।
শেং যখন ক্ষমতার শীর্ষ শিখরে তখন তার বাহিনী একদিনেই পাঁচটি মার্কিন পালবাহী জাহাজ, একটি পর্তুগিজ যুদ্ধজাহাজ এবং একটি থাই নৌকা আক্রমণ ম্যাকাওয়ের বন্দরে রুখে দেয়। ১৮১০ সালে যখন শেংয়ের লাল এবং কালো পতাকা ওড়ানো দুই নৌবহরের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে এবং বাইরে থেকেও এই পরিস্থিতি সামলানোর কোন উপায় ছিল না তখন চীনের সরকার তা বন্ধের জন্য শেংয়ের বাহিনীকে আত্মসমর্পণের পুরস্কার স্বরূপ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। শেং সাও নির্দিষ্ট কিছু শর্তে চীনা সরকারের প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হন।
শেংয়ের বাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে জলদস্যু জীবনকে বিদায় জানায় ১৮১০ সালের এপ্রিল মাসে। ১৮২২ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর শেং এগারো বছরের সন্তানকে নিয়ে গুয়াংজুতে ফিরে এসে জুয়ার কারবার খুলে বসেন এবং অতীত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানেন। ৬৯ বছর বয়সে নীরবে-নিভৃতে শেং অাই সাও মারা যান যেটা জলদস্যুর জীবনে পরম সৌভাগ্যের একটি ব্যাপার!