এরশাদ-রওশন দ্বন্দ্ব: আবারো ভাঙনের মুখে জাপা
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। পাশাপাশি অলিগলি চায়ের দোকানসহ প্রায় সর্বত্রই এখন আলোচনার বিষয় আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
ইতিমধ্যেই নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে চলছে নানা মেরুকরণ। ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো চাচ্ছে যেকোনো মূল্যে পরিবর্তন ঘটাতে।
এদিকে একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশনের দ্বন্দ্ব ফের চরমে উঠেছে। এ দ্বন্দ্বের জেরে পার্টি ফের ভাঙনের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে দলের মধ্যে সৃষ্ট গ্রুপিংই মূলত আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে দলটির একাধিক সূত্র।
ওই নির্বাচনের পর সরকারের ক্ষমতার অংশীদার হওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব কিছুটা কমে এলেও আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুজনের নেতৃত্বে দলের অভ্যন্তরে বিদ্যমান গ্রুপিং আবারও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দুজনের দ্বন্দ্বের জের ধরে আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পূর্বঘোষিত দলের মহাসমাবেশটিও হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন সন্নিকটে এলেই জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের আচার-আচরণ সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। এবারও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরশাদ নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকবেন কি না, নাকি বিএনপি জোটে শরিক হবেন এ নিয়ে অবিশ্বাস ও সন্দেহ দানা বাঁধছে।
গতবার শেষ সময়ে এসে তিনি জাতীয় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার নির্দেশে আড়াইশ’রও বেশি প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও দলের ভাঙনের শঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছিল।
যদিও শেষপর্যন্ত সেটা আর হয়নি। রওশনের কারণে এরশাদ এখনো মহাজোট সরকারের ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ভোগ করছেন। কিন্তু সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তিনি আবার ডিগবাজির চেষ্টা করছেন। শেষ সময়ে এরশাদ মহাজোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভিড়ে যেতে পারেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে- এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যেও এ নিয়ে দুশ্চিন্তা কাজ করছে। তবে ভরসাস্থল রওশন এরশাদ এখনো তাদের (আওয়ামী লীগ) অনুকূলেই রয়েছেন।
রওশনের অতিরিক্ত আওয়ামী লীগ ঘেঁষা নীতিই এরশাদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে দলটির একটি সূত্র। এরশাদের ধ্যানে-জ্ঞানে রয়েছে আরেকবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া। আর রওশনের ধ্যানে-জ্ঞানে রয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতার অংশীদার থাকা।
দুজনের দুই নীতির কারণে দলের অভ্যন্তরে এরশাদ ও রওশন গ্রুপের নামে বিভক্তি এখন প্রকাশ্য। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থেকে এরশাদের রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশ পূর্ণ হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তাই তিনি বারবার চেষ্টা করেছেন বিএনপি জোটের সঙ্গে ভিড়ে তার খায়েশ পূরণের পথকে পরিষ্কার করার।
ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে এ ব্যাপারে এরশাদের কথাবার্তা বা দেনদরবারও হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপির একটি সূত্র। সম্প্রতি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে ব্যক্তিগত দূত পাঠিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের খোঁজখবর নিয়েছেন তিনি।
এদিকে আগমীকাল ৭ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে বৈঠকে বসবেন প্রেসিডিয়াম সদস্যরা। ওই বৈঠকে জাতীয় পার্টির এমপিদেরও অংশ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, এটি প্রেসিডিয়াম সদস্যদের একক বৈঠক নয়। এটিকে যৌথসভা বলা যায়। আমরা ওইদিন সবাই মিলে আলোচনা করব।
জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা গেছে, প্রেসিডিয়াম সদস্যদের ওই বৈঠকে বিএনপির পাশাপাশি ১৪ দলীয় জোট বিষয়ে নীতিগত অবস্থানও স্পষ্ট করা হবে।
** জাতীয় পার্টির জন্ম **
মওদুদ আহমদের ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন’ বই থেকে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে এরশাদ প্রথমে জনদল নামে একটি রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন ঘটান। ৮৫ সালের প্রথম দিকে এরশাদ দুটি প্রধান বিরোধী জোটে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হন। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা কোরবান আলী ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল হালিম চৌধুরীকে তিনি মন্ত্রিত্ব দেন। পনেরো দলীয় জোটের শরিক দল মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একাংশ, পাঁচদলীয় জোটের শরিক ইউপি পির কাজী জাফর আহমেদ ও সিরাজুল হোসেন খানের গণতন্ত্রী দল জোট ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়। বিএনপির একটি অংশের নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী ও ড. এম এ মতিন এবং আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইফ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান। এ ছাড়া বিএনপির জিয়াউদ্দিন আহমেদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মতো কিছু নেতা, মুসলিম লীগের একাংশের নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, দলবিহীন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান। ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে এরশাদ তাঁর জনদল, বিএনপির একাংশ, ইউপি পি, গণতান্ত্রিক পার্টি এবং মুসলিম লীগের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় ফ্রন্ট। একপর্যায়ে কাজী জাফর স্বেচ্ছায় ইউপি পি ভেঙে দিয়ে এরশাদের দলে যোগ দেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘সরকারি রাজনৈতিক দল’ জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির বর্তমান সদস্য মওদুদ আহমদও সে সময় জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে উপ রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
আর জাতীয় পার্টির নিজস্ব পরিচিতিতে বলা আছে, ১৯৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি জাতীয় ফ্রন্টের ৫টি শরিক দল একত্র হয়ে জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নবগঠিত পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন এইচ এম এরশাদ এবং মহাসচিব নিযুক্ত হন এম এ মতিন।
** পার্টিতে ভাঙন **
এরশাদের জাতীয় পার্টিতে প্রথম বড় ধরনের ভাঙন ধরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বের হয়ে আলাদা জাতীয় পার্টি ঘোষণা করলে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের সময় জাতীয় পার্টি প্রথমে তাদের সমর্থন দিলেও পরে চারদলীয় জোটে চলে যায়। সেসময়ের যোগাযোগ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন ধরে। নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে নির্বাচনে যায়। বর্তমানে এই অংশের নেতৃত্বে আছেন আন্দালিব রহমান।
এই অংশটির ভেতরও আরেকটি ভাঙন আছে। মন্ত্রিত্ব নিয়ে ঝামেলার একপর্যায়ে এম এ মতিন আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন।
এক এগারোর সময়ও জাতীয় পার্টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়েছিল, পরে অবশ্য এ দুটি অংশই এরশাদের নেতৃত্বে এক হয়ে যায়।
সর্বশেষ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরান তার পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমেদ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন বিএনপি-জোটে। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে দলের বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন জাতীয় পার্টির ঘোষণা দেন কাজী জাফর। একই সঙ্গে তিনি এরশাদকে বহিষ্কারেরও ঘোষণা দেন।