সম্রাট অশোক: পৃথিবীর ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী নৃপতি
লক্ষ লক্ষ বছর পুরনো এই পৃথিবীতে মানবসভ্যতার ইতিহাস মাত্র আট হাজার বছরের। মানুষ তার সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছে কত বিচিত্র সভ্যতা, সাম্রাজ্য। কতো বিত্তশালী রাজা মহারাজা শাসন করে গেছেন দুর্দণ্ড প্রতাপে। কিন্তু কাল খুব নিষ্ঠুর। তার করালগ্রাসে পতিত হতে হয়েছে সবাইকে। কেবল তাদেরই স্মৃতি মনে রেখেছে পৃথিবী যারা তাদের আপন বৈশিষ্ট্যে আলোকিত করে গেছেন সময়কে। সম্রাট অশোক ছিলেন এমনই এক মহান মানুষ। তিনি রাজা বা সম্রাট হয়েও ছিলেন মহৎ ও শ্রদ্ধার্হ। সম্রাট অশোক ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র।
৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটালিপুত্র। নয় মাইল ব্যাপী অতিশয় মনোরম আর সুদৃশ্য নগরী। নগরীর চারদিক ঘিরে ছিল চৌষট্টিটি বিরাট সিংহদ্বার, এছাড়াও আরো কয়েকশত ছোটো ছোটো প্রবেশদ্বার ছিল। বাড়িঘর বেশীরভাগ ছিল কাঠের তৈরি। আগুন লাগবার আশঙ্কা ছিল বলে সে বিষয়ে সবিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা ছিল। প্রধান প্রধান রাস্তায় হাজার হাজার জলপাত্র সারাক্ষণ জলে ভর্তি করে রাখা হত। প্রত্যেক গৃহস্থের উপর বাড়িতে জলপাত্র রাখার হুকুম ছিল। তাছাড়া মই, আঁকশি প্রভৃতি অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসও রাখতে হতো। খৃষ্টপূর্ব ২৯৬ সালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যু হলে তার পুত্র বিন্দুসার সিংহাসনে আরোহণ করলেন। বিন্দুসার প্রায় পঁচিশ বছর রাজত্ব করেন। বিন্দুসারের পর ২৬৮ খ্রিস্টাব্দে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হলেন অশোক। সে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারত, এমনকি মধ্য এশিয়ার খানিক অংশ। সিংহাসনে বসবার নবম বৎসরের দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব ভারতের অন্যান্য অংশগুলো রাজ্যের মধ্যে আনবার সংকল্প নিয়ে অশোক কলিঙ্গবিজয় আরম্ভ করলেন।
ভারতের পূর্ব উপকূলে কলিঙ্গদেশ বর্তমানে ওডিশা নামে পরিচিত। কলিঙ্গবাসীরা যুদ্ধ করলো বীরের মতো কিন্তু অশোকের পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীর সাথে পেরে উঠলোনা। এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর বিজয় অর্জিত হলো। এই সংগ্রাম ও বীভৎস অত্যাচার এত গভীরভাবে অশোককে আঘাত করলো যে, যুদ্ধ ও সকলপ্রকার সামরিক কার্যকলাপের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মে গেল। অশোক যুদ্ধের এই ভয়াবহতা দেখে নিজের ভেতর এক বিষাদ অনুভব করলেন। এত রক্তপাত আর হত্যাকান্ডের বিনিময়ে অর্জিত রাজত্বের প্রতি নিরাসক্ত বোধ করলেন।
এরপর তিনি আর যুদ্ধ করলেন না। দক্ষিণের এক ক্ষুদ্র খন্ড বাদে সমগ্র ভারত ছিল তার অধীন আর এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডটিও তিনি অনায়াসে জয় করতে পারতেন। এইচ, জি, ওয়েলসের লিখেছেন, ইতিহাসে পাতায় তিনিই একমাত্র সম্রাট যিনি বিজয়লাভ সত্ত্বেও যুদ্ধবৃত্তি ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। অশোক গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতির প্রতি আকর্ষণ বোধ করলেন এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে বৌদ্ধধর্মের বাণী প্রচারের জন্য চেষ্টা করলেন। সম্রাট অশোকের ধর্ম পালন মন্ত্র উচ্চারণ আর পূজা অর্চনায় ছিলনা, মহৎ সামাজিক উন্নয়নের জন্য তিনি মনোনিবেশ করলেন। দেশজুড়ে নির্মিত হলো বাগান, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট।
প্রজাদের সুপেয় পানীয়জল এর অভাব পুরণের জন্য নির্মাণ করা হলো অসংখ্য কুয়ো। নারীশিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হলো। বিশাল বিশাল চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলো, সেখানে জ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখার পাঠদান করা হতো। এমনকি সম্রাট অশোক পশুপাখিদের জন্যও হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। এভাবে প্রজাদের উন্নতির জন্য কাজ করে করে প্রায় ৩৬ বছর রাজত্ব করে ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোক মৃত্যুবরণ করেন।
অশোক ছিলেন একজন অসাধারণ প্রজাহিতৈষী সম্রাট।
বিশ্বখ্যাত লেখক এইচ, জি, ওয়েলস তার ‘ইতিহাসের কাঠামো’ বইতে সম্রাট অশোক সম্বন্ধে শ্রদ্ধাপূর্ণ কথা লিখেছেন। তিনি লিখছেন, “ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ভিড় করে রয়েছে যেসব রাজা রাজড়াদের নাম, তাদের মধ্যে সম্রাট অশোকের নামের দীপ্তি নক্ষত্রের সমান। ভোল্গা থেকে জাপান পর্যন্ত আজও তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। চীন, তিব্বত এবং তার ধর্মত্যাগ করা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ তার মহিমার ঐতিহ্যকে আঁকড়ে রেখেছে।কনস্টানটাইন বা শার্লামেনের নাম যারা শুনেছে তাদের চেয়ে ঢের বেশি লোকের স্মৃতিপটে অশোক অবিস্মরণীয়।”
সম্রাট অশোকের এত বড় সম্মান পৃথিবীর মানুষের কাছে। সাম্রাজ্যের সর্বব্যাপী লোভের ভেতর থেকে নিজেকে মুক্ত করে ভালোবাসা আর প্রজাপালনের পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন। ইতিহাসের পাতায় সম্রাট অশোকের নাম তাই লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।