আমন চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন সাতক্ষীরার কৃষক
সাতক্ষীরা জেলায় আমনের চাষ ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। শুধু গত ছয় বছরে আমনের আবাদ অর্ধেকে নেমে এসেছে। পরিবেশ বিপর্যয়, জমিতে লবণ বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা ও অনিয়ম তান্ত্রিকভাবে ঘের করার কারণে জেলায় ধানের আবাদ হ্রাস পাচ্ছে। এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে আগামী ১০ বছরে মধ্যে সাতক্ষীরায় আমনের উৎপাদন শূন্যের কোটায় নামতে পারে শঙ্কা। বিগত ৬ বছরে জেলাতে আমন উৎপাদনের চিত্র দেখলে এমনটায় মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এতে জেলাতে বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নাঞ্চল থেকে জেলা শহরের দিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ অব্যাহত রয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময়ে কাজ না পেয়ে তারা সাতক্ষীরা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলে আমন ও ইরি মৌসুমে জেলাতে শ্রমিক সংকট প্রবল আকার ধারণ করে। অধিক মজুরি দিয়েও শ্রমিক না পাওয়াতে জেলার মানুষ ধান চাষের প্রতি আগ্রহ কমছে। ফলে আমনের আবাদ কমিয়ে মাছ চাষের দিকে ধাবিত হচ্ছে তারা। এতে কর্মসংস্থান কমে বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহমান কাল থেকে এ ধানেই কৃষক তার পরিবারের ভরণপোষণ, পিঠেপুলি, আতিথেয়তাসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে থাকতো। কিন্তু বর্তমানে তা যেন শুধু স্মৃতি হতে চলেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলায় ৬০ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১৬ হাজার ৪ শত ৮০ হেক্টর, কলারোয়া উপজেলায় ১১ হাজার ৬ শত হেক্টর, তালা উপজেলায় ৪ হাজার ৭ শত হেক্টর, দেবহাটা উপজেলায় ৩ হাজার৮ ২ শত হেক্টর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ১১ হাজার ২৫০ হেক্টর, আশাশুনি উপজেলায় ৩ হাজার ৫২ শত ২০ হেক্টর ও শ্যামনগর উপজেলায়৮ হাজার ৭ শত ৫০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হচ্ছে। যা বিগত বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ কম।
আমন রোপণ শেষ করে বর্তমানে চাষিরা পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে। আগাছা দমন, সার প্রয়োগসহ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কৃষকরা নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চাষিরা বলছে উপযুক্ত পরামর্শের অভাবে সব জমি আমন চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। আর কৃষিবিদরা বলছে সবধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে নিয়ম মেনে আমন চাষ করলে উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আমন উৎপাদনের লক্ষ মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে আশা জেলা খামার বাড়ির।
২০১৭- ১৮ মৌসুমে আমনের আবাদ হয় জেলায় ৮৩ হাজার ৭ শত ৬৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৭ হাজার ৮ শত ৮০ হেক্টর, কলারোয়া উপজেলায় ১১ হাজার ৩ শত ৮০ হেক্টর, তালা উপজেলায় ৭ হাজার ৩ শত ১০ হেক্টর, দেবহাটা উপজেলায় ৫ হাজার ২ শত হেক্টর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ১৭ হাজার ১৫ হেক্টর, আশাশুনি উপজেলায় ৯ হাজার ২ শত ৩০ হেক্টর ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫ হাজার ৭ শত ৫০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হচ্ছে।
২০১৬-১৭ মৌসুমে জেলায় ৮৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ১৬ হাজার ৫২৫ হেক্টর, কলারোয়ায় ১১ হাজার ১৫৫ হেক্টর, তালায় ৮ হাজার ৬৯৫ হেক্টর, দেবহাটায় ৮ হাজার ১৮০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ১৬ হাজার ৯৫৫ হেক্টর, আশাশুনিতে ৯ হাজার ৭৫৫ হেক্টর এবং শ্যামগনর উপজেলাতে ১৬ হাজার ৯৫ হেক্টর জমিতে। যা বিগত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ কম।
২০১৫-১৬ মৌসুমে জেলায় আমনের আবাদ হয় ৯৪ হাজার ২০০ হেক্টর। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২৩ হাজার ৬৬০ হেক্টর, কলারোয়ায় ১২ হাজার ৬৭৫ হেক্টর, তালায় ৯ হাজার ২৫০, দেবহাটায় ৫ হাজার ৪২০, কালীগঞ্জে ১৬ হাজার ৬১৫, আশাশুনিতে ১০ হাজার ৩৩৪ ও শ্যামনগরে ১৬ হাজার ২৫০ হেক্টর। ফলে নিয়ম তান্ত্রিক ভাবে এ জেলাতে আমনের আবাদ উল্লেখ যোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানায় ২০১৭-১৮ মৌসুমে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে সারাদেশে আমন আবাদ এরিয়া ২% বৃদ্ধি পায়। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রতি বছর আমনের উৎপাদন বাড়ছে। যেখানে সাতক্ষীরা জেলাতে হ্রাস পাচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছে আমন ধানের ফলন বৃদ্ধি করতে ভালো বীজ নির্বাচন, জমি তৈরি, সঠিক সময়ে বপন বা রোপণ, আগাছা দূরীকরণ, সার ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা ও সম্পূরক সেচ দেয়া দরকার। আবহাওয়া ও মাটির উর্বরতার মান যাচাই এবং ধানের জাত, জীবনকাল ও ফলন মাত্রার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা ঠিক করা দরকার। ধানে থোড়ের শেষ পর্যায় অথবা শীষের মাথা অল্প একটু বের হওয়ার সাথে সাথে প্রতিরোধমূলক ছত্রাকনাশক ওষুধ প্রয়োগ করা দরকার।
সামাদ শেখ। খলিশ খালির মঙ্গলান্দকাটী গ্রামের জাহাতাব শেখের ছেলে সাবেক ব্যাংকার। তার ১০ বিঘা জমিতে আগে আমনের চাষ হত। বর্তমানে তিনি আমন আবাদ করে না। তিনি জানালেন, আগে যে খাল দিয়ে পানি সরতো এখন সে সব খাল আবদ্ধ খালে পরিণত হয়েছে। এসব খাল সমূহে বাঁধ দিয়ে প্রভাব শালিরা মাছ চাষ করছে। ফলে পানি সরানোর কোন ব্যবস্থা না থাকায় আমন উৎপাদন করা যায় না।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মান্নান জানান, জেলায় আমনের আবাদ কিছুটা কমছে। তবে উৎপাদনের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। এছাড়া নানা কারণে জেলাতে আমন চাষের পরিবর্তে চাষিরা বোরো ধান সহ ঘের করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। আমন উৎপাদন বৃদ্ধি করতে কৃষি কর্মকর্তারা নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে।