ছেলেদের ত্বক এবং চুলের যত্নে
প্রকৃতিগতভাবেই ছেলেদের ত্বক মেয়েদের চাইতে পুরু হয়। ছেলেদের বাইরে কাটাতে হয় দিনের বেশিরভাগ সময়ই। প্রচন্ড রোদের তাপ, বৃষ্টিতে ভিজা কাপড়ে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় কাটিয়ে দেয়া, ধুলোবালির পুরু আস্তরণ ,বিভিন্ন দূষণ এসবের ভেতর দিয়ে ছেলেদের প্রতিদিন যেতে হয়। ফলে ত্বক হয়ে ওঠে আরো রুক্ষ। যত্নের অভাবে ছেলেদের ত্বকে মেয়েদের চাইতে বলিরেখা পড়ে দ্রুত; তাছাড়া ব্রণ, মেছতা, ব্ল্যাক হেডস, চোখ ও গালের চারপাশের কালো ছোপ, চোখের কোলের কুঁচকে যাওয়া দাগ, ছিদ্রযুক্ত অমসৃণ ত্বক প্রায় সব ছেলের সাধারণ সমস্যা। তাই মেয়েদের চাইতেও বলা যায়, ছেলেদের ত্বকের প্রতি বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।
সানস্ক্রিনের ব্যবহারঃ বাইরে যাবার ১৫-২০ মিনিট আগে অবশ্যই মুখে সানস্ক্রিন লাগাতে হবে। সেটা যেকোন ঋতু বা দিনের যেকোন সময়ই হোক না কেন। পুরুষ এবং নারী উভয়ের ত্বকের জন্যই সানস্ক্রিনের কোন বিকল্প নেই। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি আমাদের ত্বকে ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী হতে পারে। সানস্ক্রিন এটি প্রতিরোধ করে। যে ব্র্যাণ্ডেরই কিনুন দেখে নিবেন তার এসপিএফ (সান প্রটেকশন ফ্যাক্টর) যেন ৩০ এর অধিক হয়। মুখের পাশাপাশি হাত, ঘাড় এসবও উন্মুক্ত থাকে। ভুলবেন না এখানেও সানস্ক্রিন লাগাতে।পারলে হালকা রঙয়ের ফুল হাতা শার্ট পরে বাইরে বের হোন।
বারবার মুখ ধোয়াঃ দিনের বেশিরভাগ সময় যেহেতু বাইরেই থাকতে হয়, তাই সাথে একটি ফেসওয়াশ রাখা যেতে পারে। নাহ, এতে ভ্রূ কুঁচকানোর কিছু নেই। গোসলে সাবান ব্যবহারের সময় নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই,শ্যাম্পুও করছেন রোজ, তাহলে কেন ব্যাগ বা পকেটে বহন করা ফেসওয়াশটি দিয়ে মুখ ধোয়ার সময় “লোকে বলবে মেয়েদের কাজ” এ চিন্তা নিয়ে চলবেন !
দিনে তিন থেকে চারবার ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিন। ধুলাবালির হাত থেকে বাঁচতে রাস্তায় বেরোলেই মাস্ক ব্যবহার করুন। আর রোদ থেকে বাড়িতে ফেরার পর পারলে একটা আইস কিউব মুখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘষে নিন। এতে রক্ত সঞ্চালন ভাল হবে, মুখের পোড়া ভাবটাও কমবে।
ব্রণের সমস্যাঃ বয়ঃসন্ধির সময় হরমোনের তারতম্যের কারণে ছেলে-মেয়ে উভয়েরই ব্রণের প্রবণতা বেড়ে যায় । মেয়েরা যেখানে জীবনের এই সময়টায় ত্বক নিয়ে প্রথমবার উদ্বিগ্ন হতে শুরু করে , ঠিক বিপরীতে ছেলেরা হয়ে ওঠে একদম উদাসীন। না জেনে অনেকেই ব্রণ খুটিয়ে মুখে সারাজীবনের জন্য কালচে ব্রণের দাগের স্থায়ী ব্যবস্থা করে ফেলে। এ সময় একদম নখ লাগানো যাবে না মুখে।ব্রণের বা অস্বস্তির পরিমান খুব বেশি বেড়ে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে।
আবার বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের পর ত্বকে আলাদা সমস্যা দেখা দেয়। এসময় ত্বকের টানটান ভাবটা একদম চলে যায়, চোখের কোল ফুলে ওঠে। গালের ও নাকের চামড়ায় দেখা দেয় অসংখ্য ছিদ্র(Pores)। তাছাড়া কারো ডায়বেটিস, কিডনি রোগ ইত্যাদি থেকে থাকলে সেগুলোর প্রভাবও চেহারায় পড়ে। খালি পেটে প্রতিদিন কুসুম গরম পানিতে লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে খেলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। ভাল ব্র্যান্ডের একটা আন্ডার আই ক্রিম কিনে পারেন এ সময়।
শেভিংয়ের সাতকাহনঃ পুরুষদের ত্বকের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে শেভ করার সময় ত্বক কেটে যাওয়া। ফলে ত্বকে অযাচিত দাগ হয়, আস্তে আস্তে ত্বক খসখসে হয়ে ওঠে। শেভের ক্ষেত্রে সবচেয়ে যেটা বেশি দরকার তা হলো জীবাণুমুক্ত ভাল মানের ব্লেড ব্যবহার।কমদামি ব্লেডের আঘাতে চামড়া কেটে যেয়ে লোমকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং কেটে যাওয়া স্থানে প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে।
রেজরও একটু দামি এবং ব্র্যান্ডের ব্যবহার করা উচিত, যা দিয়ে শেভ করলে ত্ব্কে কাটাছেঁড়ার কোন সম্ভাবনা নাই। বাজারে এখন মাল্টিব্লেডের ইলেকট্রনিক রেজর পাওয়া যায় । সেনসিটিভ এবং ব্রণপ্রবণ ত্বকে মাল্টিব্লেডের রেজর ব্যবহার না করাই ভাল।অনেকের চেহারায় ইনগ্রোন হেয়ারের পরিমাণ বেশি থাকে। অর্থাৎ ত্বকের সবচেয়ে বাইরের স্তরের ভেতরের দিকে দাঁড়ি থাকলেও তা পুরোপুরি বাইরে বের হয় না। চামড়ার সাথে সূক্ষ্মভাবে জড়িয়ে থাকার ফলে চেহারায় এগুলো এক ধরনের ‘রেড বাম্প’ বা লালচে ফুঁসকুড়ি তৈরী করে। এ ধরনের ত্বকের জন্য ডাবল-ব্লেডের রেজর বেশি উপযোগী। এলার্জির সমস্যা যাদের ,তাদের উচিত টাইটেনিয়াম ব্লেডের রেজর ব্যবহার করা।
অনেকে আবার আফটার শেভ ব্যবহার করেন না নিয়মিত। এটি আপনার ত্বকে ব্লেডের আঁচড়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ক্ষত নিরাময় করে মুখের ত্বকের স্বাভাবিকতা বজায় রাখে। তবে আফটার শেভ যেন এলকোহল ফ্রী হয় সেটা খেয়াল রাখবেন। এলকোহল ত্বককে রুক্ষ করে দেবে। আফটার শেভ না থাকলে হালকা,তেলহীন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবেন। নাহলে মুখে একটা সাদাটে, শুষ্কভাব বিরাজ করবে।
স্পর্শকাতর ত্বক যাদের,তাদের উচিত গোসলের সময় বা গোসলের পরপরই শেভ করে ফেলা। কারণ সেসময় শরীর থেকে যে গরম ভাপটা বের হয় তা লোমকূপ আলগা করে দিতে সাহায্য করে। তাছাড়া দাঁড়ি ভেজা থাকলে ব্লেডে শতকরা ৩০ভাগ কম চাপ প্রয়োগ করতে হয়।
ত্বক মসৃণ রাখে এমন শেভিং জেল ব্যবহার করবেন।আর হাত নয়, ফোমিং ব্রাশ দিয়ে গালে শেভিং জেল লাগাবেন। কারণ যতবার ব্রাশের নরম প্রান্তগুলো মুখের ওপর ঘুরবে দাঁড়ির গোড়া ততই নরম হবে।
ত্বক পরিষ্কারে স্ক্রাবিং: সপ্তাহে দুটো দিন শেভিং করার পর স্ক্রাবিং করার চেষ্টা করুন। স্ক্রাবিং ত্বকের মরা কোষ নির্মূল করে, ত্বককে একেবারে ভেতর থেকে পরিষ্কার রাখে। আর স্ক্রাবিংয়ের মাধ্যমে ব্রণ বা একনে থেকেও মুক্তি পাওয়া যায় । স্ক্রাবিং এর সময় পুরো চেহারা তিন-চার মিনিট ম্যাসাজ করা লাগে। ফলে নিয়মিত স্ক্রাবিং করলে ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে না,ত্বকের উজ্জ্বলতাও বাড়ে। মার্কেট থেকে পছন্দমত স্ক্রাবার কিনে আনতে পারেন।
ধূমপানে বিষপানঃ ধূমপান শুধু স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, ত্বকের জন্যও ক্ষতিকর।দীর্ঘদিন ধূমপানের ফলে ঠোঁটের ত্বক ফেটে যায় , ঠোঁট কালো হয়ে যায় ।সাথে সব সময় একটি লিপবাম রাখুন। আর আস্তে আস্তে ধূমপান পরিহারের চেষ্টা করুন ।
ফেসপ্যাক ব্যবহারঃ মাসে একবার অন্তত কোন স্যালনে গিয়ে ত্বকের ধরন অনুযায়ী ফেসিয়াল করাতে পারেন। যদি ত্বকের ধরনও বুঝতে না পারেন ,তাহলে হারবাল ফেসিয়ালটা করিয়ে নিন। এতে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আর বাজারে নানান প্যাক পাওয়া যায়। রাতে সবার ঘুমের পর বা নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে চুপিচুপি ত্বকচর্চা করতে হবে না। বোন, মা, ভাবি, স্ত্রী কিংবা ছোট ভাই যেই থাকুক তার সাথে মিলেই মুলতানি মাটি, চন্দন, বেসন, টমেটো কিংবা শসা-আলুর রস মেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন, পারতপক্ষে অন্তত একদিন এটা করুন। সবাই মিলে বাড়িতে রূপচর্চার সময় যে আনন্দটুকু পাবেন,গ্যারান্টি দিচ্ছি তা পার্লারের হাজার টাকার ফেসিয়ালেও আসবে না ।
পায়ের যত্নেঃ অনেককেই অফিসে একটা দীর্ঘ সময় পায়ে মোজা পরে থাকতে হয়। ঘামে ভিজে পা স্যাঁতস্যাতে হয়ে থাকে। এসময় পায়ের তালুতে, আঙুলে ছত্রাকের আক্রমণ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। রাতে বাড়ি ফিরে গামলায় সামান্য গরম পানি নিয়ে কিছু শ্যাম্পু মেশান এবং এক মুঠো লবণ ছিটিয়ে দিন। ১০মিনিটের মত তাতে পা ডুবিয়ে বসে থাকুন। লবণ দারুণ জীবাণুনাশক।
গোসলের সময়ও রোজ ঝামাপাথর দিয়ে পায়ের গোড়ালিটা ঘষে নিতে পারেন। মৃত কোষগুলো বেরিয়ে যাবে।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুনঃ প্রচুর পানি পান করতে ভুলবেন না। পানি শরীরের সব টক্সিন বের করে দেয়। বাইরে বেরোলেই অনেকে কয়েক কাপ চা খেয়ে ফেলেন। এ অভ্যাস ত্যাগ করুন। বরং খান ফলের রস। তাছাড়া ঢাকা শহরের রাস্তায় অনেক ডাব বিক্রি করতে দেখা যায়।কোল্ড ড্রিংসের পরিবর্তে দিনে একটা করে ডাব খান। তৈলাক্ত খাবার কম খান। বিভিন্ন দাওয়াত বা পার্টিতে ভারী খাবার এড়িয়ে সবজি এবং সালাদ খেয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকুন।
ছেলেরা ঘামেন অনেক বেশি। ফলে মুখের পাশাপাশি অনেক ছেলের পিঠেও ব্রণ উঠতে দেখা যায় । যারা ব্যায়াম করেন, জিমে যান তাদের এই সমস্যা আরো প্রবল। চেষ্টা করুন এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও স্যালিসাইলিক এসিড সমৃদ্ধ সাবান ব্যবহার করতে। শার্ট, টিশার্ট যাই পরুন না কেন তা যেন সুতির অথবা ঘামশোষক কাপড়ের হয়।
অনেকে অবসরে সাঁতার কাটতে পছন্দ করেন। সুইমিং পুলের পানিতে ক্লোরিন থাকে। এটা ত্বকের জন্য দারুন ক্ষতিকর। পুলে নামার আগে যেমন পানিরোধক সানব্লক লোশন ব্যবহার করবেন ,তেমনি পুল থেকে উঠেই দ্রুত ভালভাবে গোসল করে নিবেন।
চুলের যত্ন
ভাবুন তো আপনার চুলে যদি খুশকি থাকে এবং তা যদি হয় ভালরকম দৃশ্যমান তাহলে সামনের মানুষটির ওপর আপনার ইম্প্রেশনের কেমন প্রভাব পড়বে! চুল ঘামে ভিজে চিটচিটে হয়ে যাওয়াও ছেলেদের একটি কমন সমস্যা। চুলে নিয়মিত তেল দেয়া, এন্টি- ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করাটা তাই খুবই জরুরি। সাধারণ কন্ডিশনার পুরুষদের ব্যবহারের জন্য নয়, কেননা এটি লাগাতে হয় চুলের আগায়, গোড়াতে নয়। ভুল করে পুরুষদের ছোট চুলে কন্ডিশনার মেখে রেখে দিলে চুল পড়াটা বরং বাড়বে।
যারা দীর্ঘক্ষণ রোদে বা ধুলার ভেতর কাজ করেন, মাথার ত্বক যাদের ঘামে বেশি কিংবা অনেকক্ষণ হেলমেট পরে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে চুল পড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায় । চুলহীন পুরুষ কারোরই কাম্য নয়। তাই সময় থাকতে সচেতন হোন।পেঁয়াজের রস চুল পড়া কমাতে সবচেয়ে কার্যকর। মাসে একদিন মেহেদি ব্যবহার করতে পারেন।তবে কারো ঠান্ডার সমস্যা থাকলে মেহেদি লাগানোর দরকার নেই।
নারকেল বা অলিভ অয়েলের সাথে ক্যাস্টর অয়েল মিশিয়ে পুরো চুলে ব্যবহার করলেও ভাল ফল পাবেন। আর যারা হেয়ার জেল ব্যবহার করতে পছন্দ করেন তারা অবশ্যই ঘুমের আগে তা পরিষ্কার করে নিবেন। নইলে এর রাসায়নিক উপাদান চুলকে রুক্ষ করে তুলবে এবং চুল পরার কারণও হতে পারে।
“অটোগ্রাফের দিন শেষ, এখন সময় ফটোগ্রাফের” –ক্রিকেটার তামিম ইকবালের এই বিজ্ঞাপনটির কথা মনে আছে? আসলে শুধু ফটো বা ছবি ভাল আসার জন্যই তো নয়, নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের গুরুত্ব অনেক। সবকিছুর সমন্বয়েই মানুষ পরিপূর্ণভাবে ব্যক্তিত্ববান হয়ে উঠতে পারেন,তা সে নারীই হোক কিংবা পুরুষ।তাই ক্লাস, ক্যারিয়ার,অফিস, সংসার সবকিছুর ফাঁকেই নিজের জন্য একটু সময় বের করে নিন।