প্রকৃতির আয়নায় দেখুন নিজেকে
আপনি হয়ত অনেক বড় আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে! কিন্তু প্রকৃতির আয়নায় নিজেকে দেখার সৌভাগ্য কি আপনার হয়েছে? অবাক হচ্ছেন? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়নাতে নিজের রুপ দেখতে আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে বলিভিয়ায়। সেখানে রয়েছে বিশাল এলাকা বিস্তৃত একটি লবণহৃদ। সেখানে গেলেই আপনি প্রাকৃতির আয়না খুঁজে পাবেন। সেই লবণহৃদের নাম ‘সালার ডি ইয়ুন’। এর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় বলিভিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চিলির সীমান্তের সঙ্গে।
শুষ্ক মৌসুমে এই ভূমিটি দেখে মনে হবে শুভ্র শূন্যতার জগত। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো বৃষ্টিতেই এই শুষ্ক অঞ্চল রূপান্তরিত হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়নায়! এই আয়নার বুকে হাঁটার জন্য রয়েছে সুবর্ণ সুযোগ। আপনি যখন এর উপর দিয়ে হাঁটবেন তখন মনে হবে আপনি মাটি বা পানিতে নয়, হাঁটছেন আকাশের মেঘে, কোনো স্বর্গীয় জগতে। কারণ উপর নিচে স্বচ্ছ মেঘের আকাশ আর শুভ্র বর্ণের লবণ ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়বে না।
৩০ থেকে ৪২ হাজার বছর পূর্বে অনেকগুলো লেকের মিলনের ফলে সালার ডি ইয়ুনির জন্ম হয়। বর্ষায় এই হৃদটি স্বচ্ছ আয়না হিসেবে কাজ করে। স্যাটেলাইটের শক্তি বা ক্ষমতা নির্ণয়ের জন্য এটা ব্যবহার করা হয়। এই লবণহৃদটি ১০ হাজার ৫৮৩ বর্গ কি.মি এলাকাজুড়ে অবস্থিত। বর্ষার সময় আশেপাশের হ্রদগুলো থেকে পানি প্রবাহিত হওয়ার ফলে এই লবণভূমিটি প্লাবিত হয় এবং সেখানে ২০ ইঞ্চির মতো গভীর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পানির এই পাতলা আস্তরণের কারণে সেখানে আকাশের চমকপ্রদ এক প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। এই লবণহৃদের পাশেই দেখা মিলবে একটি গাঢ় গোলাপি জলের লেক। এই লেকটি আবার গোলাপি ফ্লামিংগো পাখির প্রজননের অন্যতম স্থান।
সালার ডি ইয়ুনি লবণহৃদটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দের্যে্যর আধার নয় বরং প্রাকৃতিক খনিজে ভরপুর একটি সমতলভূমি। এখানে রয়েছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, লিথিয়ামসহ ম্যাগনেসিয়াম। তার মধ্যে লিথিয়ামের অংম সবচেয়ে বেশি। আমেরিকার ভূগোলবিষয়ক জরিপ অনুযায়ী এই লবণহৃদে ৯ মিলিয়ন টন লিথিয়াম ধাতু রয়েছে। তাছাড়া পুরো বিশ্বের মোট লিথিয়াম ধাতুর ৫০-৭০ শতাংশ মজুদ এখানে রয়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ অধিদপ্তরের এক জরিপ অনুযায়ী সালার ডি ইউনির বিশাল এলাকা, পরিষ্কার আকাশ এবং ভূমি অত্যন্ত সমতল হওয়ার কারণে তা মহাকাশ থেকে স্যাটালাইটের মাধ্যমে ভূমির উচ্চতা মাপার জন্য খুবই উপযোগী।
এই অঞ্চলের তাপমাত্রা সবসময় নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এখানে স্থিতিশীল তাপমাত্রা থাকে। ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং জুন মাসে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। কিন্তু সারা বছরই রাতে তাপমাত্রা -৯ থেকে -৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। সেইসঙ্গে বছরের ৩০ থেতে ৪০ শতাংশ সময়ে আর্দ্রতা উঠা নামা করে। এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত প্রতি মাসে ১-৩ মিলিমিটার কম হলেও জানুয়ারিতে এটি ৮০ মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে জানুয়ারিতে বৃষ্টিপাত বেশি হলেও এখানে প্রতি মাসেই প্রায় ৫/৬ দিন বৃষ্টিপাত হয়।
সালার ডি ইয়ুনির সঙ্গে সংযুক্ত গোলাপি লেক পাখির প্রজননভূমি হিসেবে বিশেষ খ্যাত। প্রতি নভেম্বরে এই গোলাপি হৃদ দক্ষিণ আমেরিকার তিন প্রজাতির ফ্লেমিংগো- চিলিয়ান, আন্দেয়ান এবং বিরল জেমস এসব পাখির প্রজনন ঘটে। এছাড়াও প্রায় ৮০ প্রজাতি পাখির আনাগোনায় মুখরিত হয়ে থাকে গোলাপি হৃদ। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে- হর্ণড কুট, অ্যান্ডেইন গুস, আন্দিনি হিলস্টার সহ আরো অনেক।
মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ‘সালার ডি ইয়ুন’ এলাকাটি শুষ্ক মৌসুমে সমতল ভূমির ওপর দিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে করে ভ্রমণ করা যায়, যা বর্ষার সময় সম্ভব নয়। আপনি যদি এখানে প্রাকৃতিক আয়নার বিভিন্ন অলিক খেলা উপভোগ করতে চান তাহলে বর্ষা মৌসুমে আসুন এবং এই সময়টিতে কোন রকম যানবাহন ছাড়া শুধু পায়ে হেঁটেই আপনি এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারবেন। তবে বর্ষার দুর্গম আবহাওয়ার ফলে এখানকার যাত্রা প্রায়শই বন্ধ করে দেয়া হয় এবং বেশ দীর্ঘ সময় ধরে যাতায়াত বন্ধ থাকে। তবে কাছাকাছি ওরুরো ও ভিলাজোন সিটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত ট্রেন। আর লা পাজ থেকে যেতে পারেন গাড়িতে। এছাড়া ট্যুর অপারেটরদের গাড়ি তো রয়েছেই। তবে ভ্রমণের সময় পর্যাপ্ত খাবার ও পানি নিতে কিন্তু ভুলবেন না।