ভারতের স্বামী পরিত্যাক্তা’ বধূদের লুকানো দুঃখ
ডি এস ডেস্ক:
ভারতের চন্ডিগড়ের একটি গোপন জায়গায় চলছে কিছু নারীর বিশেষ একটি বৈঠক। সারা পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে এখানে এসেছেন এসব নারী। তাদের উদ্দেশ্য, নারী বিষয়ক একটি দাতব্য সংস্থার প্রধান আমনজত কৌর রামুয়ালিয়ার কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া। বিদেশ থেকে যেসব পুরুষ ভারতে এসে বিয়ে করে এবং পরে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে চলে যায়, সেসব নারীকে নিয়ে কাজ করে সংস্থাটি।
রামুয়ালিয়ার হিসাব অনুসারে, সারা রাজ্যে এই অবস্থার শিকার নারীর সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। এই নারী জানান, প্রতিদিন তার কাছে প্রায় ১৫ জন ভুক্তভোগী আসে। আর এ ধরনের নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তার ভাষায়, ‘আমি অনেক সুন্দরী, শিক্ষিত নারী দেখেছি। তারা সবাই ভয়াবহ অবস্থার শিকার।’
রামুয়ালিয়া বলেন, ‘পরিত্যক্ত স্ত্রী হিসেবে কোনো সমাজে বাস করতে তারা সংকোচ বোধ করেন। আমি মনে করি, এটা মানবাধিকারের একটি ভয়াবহ লঙ্ঘন।’
এসব নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পুরুষরা এসে তাদের বিয়ে করে। তবে বেশিরভাগই আসে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মতো দেশগুলো থেকে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার প্রচুর মানুষ বাস করে। বিদেশে একটি উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ওইসব পুরুষদের বিয়ে করতে রাজিও হয় এসব নারী।
তবে বিদেশি পুরুষরা এখানকার নারীদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে ভালোবাসার চেয়ে অর্থটাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। এসব বরদের এক তৃতীয়াংশই আসে যুক্তরাজ্য থেকে। রামুয়ালিয়া বলেন, ‘তারা এখানে আসে এবং বড় অংকের যৌতুক দাবি করে। এরপর বিয়ে করে। পুরুষটি টাকা-পয়সা হাতে পায়, মধুচন্দ্রিমা শেষ করে। তারপর আর কখনোই ফিরে আসে না।’
কনের পরিবারের পক্ষ থেকে বরকে যৌতুক দেয়া ভারতের সমাজে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই এই প্রথার প্রচলন আছে। ১৯৬১ সালে একটি আইনের মাধ্যমে এ প্রথা ভারতে নিষিদ্ধ করা হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ পাওয়া যায় না। এই যৌতুকের পরিমাণ কখনো কখনো কোটি টাকার কাছে চলে যায়।
চন্ডিগড়ের বৈঠকে অংশ নেয়া একজন নারী পাঞ্জাব প্রদেশের দূরবর্তী একটি গ্রাম থেকে এসেছেন। কমলজিৎ কৌর নামের এই নারী তিন বছর আগে ইতালি থেকে আসা এক লোককে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই ওই বিদেশী তাকে রেখে চলে যায়। যদিও কমলজিৎ তখন গর্ভবতী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিয়ের পরপরই সে যৌতুকের জন্য চাপ দিতে থাকে। সে আমাকে বলতে থাকে, তার পরিবার আমাকে নিয়ে খুশি নয়।’
শেষ পর্যন্ত ভারত ছেড়ে ইতালি ফিরে যায় কমলজিতের স্বামী। এরপর আর কখনোই দেখা হয়নি তাদের। কমলজিৎ আরো বলেন, ‘তারা বলতে থাকে, আমার শিশুটি বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিয়েছে। আমার জন্য তাদের আর কিছুই করার নেই। আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ।’
দুঃখজনকভাবে, কয়েক মাস পরেই কমলজিতের বাচ্চাটি মারা যায়। তার স্বামীও আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
ভারতে বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বিচ্ছেদে যাওয়া একটি অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। এতে নারীদের পরিবারগুলোই ক্ষতির শিকার হয়।
১৯৯৭ সালে বিয়ে হয়েছিল দর্শনের মেয়ের। একটি কন্যা সন্তান হওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয়। অথচ এখনো সেই সম্পর্কে ইতি টানতে টানতে পারেনি তারা। দর্শনের মেয়ের ভাষায়, ‘ছেড়ে যাওয়ার আগে সে আমাদের কিছুই বলেনি। পরে জানায়, বিদেশে স্ত্রী আছে তার। সেখানে তার এক ছেলে এবং মেয়ে আছে। তাই আমার মেয়েকে গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় যাই। এটাও ১৬ বছর ধরে আটকে আছে।’
পাঞ্জাবের ভুক্তভোগী নারীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘নন-রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান কমিশন অব পাঞ্জাব’। সংগঠনটির আইনজীবী দলজিৎ কৌর বলেন, ‘আমাদের আইনি প্রক্রিয়া অনেকটা ধীর গতির। এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত পেতে কয়েক বছর লেগে যায়। নানা জটিলতা আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মতো অর্থ তাদের নেই।’
এসব বিষয়েই ভুক্তভোগী নারীদের নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন আমনজাত কৌর রামুয়ালিয়া। তবে এতে আছে অনেক সীমাবদ্ধতা। এভাবে স্ত্রীকে ছেড়ে যাওয়া ভারতের আইনে অপরাধ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বিদেশী নাগরিকদের আইনের আওতায় আনা খুবই কঠিন।
রামুয়ালিয়া বলেন, ‘একটি মেয়েকে তারা বিয়ে করে। একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ধর্ষণ করে এবং গর্ভে একটি সন্তান দিয়ে চলে যায়। এমন কোনো শক্তিশালী আইন নেই, যা এটা প্রতিরোধ করতে পারে। একজন পরিত্যক্ত স্ত্রীর লজ্জা নিয়েই তাকে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হয়।’
এ বিষয়ে অন্য দেশের নাগরিকদেরও সচেতন হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন এই নারী অধিকার কর্মী। ভারত সরকারের সঙ্গে সেসব দেশের সরকারের যোগাযোগের ওপর জোর দেন তিনি। বিদেশি সরকারগুলোরও দায় আছে, তাদের দেশের যেসব নাগরিক এ ধরনের প্রতারণা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার।