প্রাথমিক স্তরে একীভূত শিক্ষা ও বাস্তবতা

প্রাথমিক শিক্ষা জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের বুনিয়াদি ভিত্তি। এই ভিত্তি যত মজবুত ও সুগঠিত হবে জাতির মেরুদণ্ড ততই শক্তিশালী হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন এবং গুণগত মানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে; যার মধ্যে “একীভূতকরণ” একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। একীভূতকরণ কেবল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাঠ্যক্রম, শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষণ পদ্ধতিকে একই ছাতার তলে আনা নয়, বরং একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ ও সমন্বিত শিক্ষার জগৎ গড়ে তোলা । একীভূতকরণের মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, গুণগত মান উন্নয়ন এবং সর্বোপরি একটি সমতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব। UNESCO-র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, যে সব দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় একীভূতকরণ সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, সেখানে শিক্ষার গুণগত মান উন্নত হওয়ার সাথে সাথে ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে এসেছে।
* একীভূতকরণ শিক্ষা; সকল শিশুকে শিক্ষার মূল ধারার সাথে সম্পৃক্ত করা অর্থাৎ সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, লিঙ্গ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুসহ সকল অঞ্চলের শিশুদের মূল শিক্ষাধারার সাথে সম্পৃক্ত করে সমতা ও সাম্যতা নিশ্চিত করাই হলো একীভূত শিক্ষা বা Inclusive Education.
*একীভূতকরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি প্রতিটি শিশুকে সহনশীল ও সামাজিক শিক্ষাদান, সমতা ও নায্যতার ভিত্তিতে চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষালাভের অধিকার নিশ্চিত করা ও বৈষম্য দূর করা,
মানসম্মত পাঠ্যক্রম, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং উন্নত শিক্ষাসামগ্রীর মাধ্যমে সামগ্রিক শিক্ষার মান উন্নত করা।
*একীভূতকরণের গুরুত্ব :
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করাই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাই পরবর্তী শিক্ষা জীবনের ভিত্তি প্রস্তুত করে। একটি দৃঢ় ও সুসংহত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া উচ্চতর শিক্ষায় সাফল্য অর্জন করা দুষ্কর। একীভূতকরণ এই প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর করে তোলে নিম্নোক্ত উপায়ে:
১) সমান সুযোগ সৃষ্টি: একীভূতকরণ সকল শিশুর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌগোলিক পটভূমি নির্বিশেষে শিক্ষার সমান সুযোগ প্রদান করে। এটি শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করে এবং সকল শিশুকে তাদের সম্ভাবনাপূর্ণরূপে বিকশিত করার সুযোগ প্রদান করে।
২) মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ: একীভূতকরণের মাধ্যমে একটি মানসম্মত পাঠ্যক্রম, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং উন্নত শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করা সম্ভব হয়, যা সকল শিশুর জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করে। একীভূত ব্যবস্থাপনা এবং সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন শিক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। এটি অপচয় কমাতে এবং সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
৩) জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি:
একীভূত পাঠ্যক্রম সকল শিশুর মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। একই পাঠ্যক্রম অধ্যয়নের মাধ্যমে তারা একই মূল্যবোধ ও আদর্শ শিখতে পারে, যা তাদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করে।
*একীভূতকরণের প্রতিবন্ধকতা :
যদিও একীভূতকরণের অনেক সুবিধা রয়েছে, তবুও এর বাস্তবায়নের পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। এই প্রতিবন্ধকতাগুলি অতিক্রম করার জন্য সুপরিকল্পিত কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিছু প্রধান প্রতিবন্ধকতা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন: সরকারি, বেসরকারি, মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয় ইত্যাদি। এই সমস্ত বিভিন্ন ক্যাটাগরির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান ভিন্ন কারিকুলাম এবং প্রতিষ্ঠানের মানের তারতম্য একীভূতকরণের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধক।
২) বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু:
আমাদের সমাজে নানা ধরণের প্রতিবন্ধী শিশু থাকলেও বিভিন্ন শিশু গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীত্বকে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছে। শারীরিক, বুদ্ধি, শ্রবণ, দৃষ্টি, বাক ইত্যাদি হলো দৃশ্যমান প্রতিবন্ধী । পক্ষান্তরে অটিজম, মানসিক রোগসহ অসংখ্য ধরণের অদৃশ্য প্রতিবন্ধীর কথা উল্লেখ করেছেন। আর বলা হয়েছে প্রতিবন্ধীত্বের মাত্রা ৪ রকম, যথা: ১. স্বল্প মাত্রা ২. স্বাভাবিক মাত্রা ৩. তীব্র মাত্রা ও ৪. অতি তীব্র মাত্রা। সেক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যালয় পর্যায়ে স্বল্প ও স্বাভাবিক মাত্রার শুধুমাত্র শারীরিক, বুদ্ধি, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুর ভর্তির সুযোগ আছে । অবশিষ্ট ধরণ ও মাত্রার শিশুদের মূলধারায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই।
৩) নেতিবাচক মনোভাব: সামাজিক নেতিবাচক মনোভাব ও ধর্মীয় গোঁড়ামী শুধু আজকে নতুন নয়, আদিকাল থেকেই বহমান। আমাদের সংস্কৃতিতে এগুলি বড়ো ধরণের প্রতিবন্ধকতা।
৪) সমন্বয়হীনতা : বিষয় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সরকারি ও বেরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারনে একীভূতকরণ শিক্ষা বেশ পিছিয়ে আছে।
৫) জনবল ও প্রশিক্ষণ : যতটুকু সুযোগ আছে তাও লোকবল আর যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের শিক্ষার মূলধারায় ধরে রাখা খুবই কষ্টকর।
৬) সমতা ও নায্যতা: সমতা আর নায্যতা একীভূত শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এই মূল জায়গায় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। চলন, গমন, আসন, উপকরণ, শৌচাগার, নামকরণ, যোগাযোগ ইত্যাদিতে আমরা উদার মানসিকতা, লজিস্টিক সাপোর্ট, সমতা ও সাম্যতার পরিচয় দিতে পারছি না।
৭) শিক্ষকমণ্ডলীর আন্তরিকতা : শিক্ষার সবচেয়ে তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষকদের অবস্থান। শিক্ষকদের পরিচর্যা শিশুর জীবন গঠনের জন্য অপরিহার্য। সকল শিক্ষক সমস্যাগ্রস্ত সকল শিশুর প্রতি আন্তরিক ও সমভাবাপন্ন না হলে একীভূত শিক্ষার বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে ।
*সমাধান: সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়নের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সাথে সমন্বিত করা।
সাধ্যমত পর্যাপ্ত অর্থ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, শিক্ষাসামগ্রী এবং ভৌত অবকাঠামোর অভাব একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। তাই শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বিস্তৃত করা, গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাসামগ্রী উৎপাদন ও বিতরণ এবং বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন একান্ত জরুরি ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিদ্যমান সামাজিক মনোভাব যেমন: মাদ্রাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার প্রতি পৃথক মনোভাব একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করা এবং সকল প্রকার শিক্ষাকে সমমর্যাদা প্রদান করা প্রয়োজন।
একীভূতকরণ বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি অপরিহার্য। এর অভাব এই প্রক্রিয়াকে ধীরগতি করে। এজন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে একীভূতকরণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক।
বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামো এবং কার্যপ্রণালীর জটিলতা একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকে দীর্ঘসূত্রী করে। এজন্য প্রশাসনিক কাঠামো সরলীকরণ, কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অধীনে উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা একটি নির্দিষ্ট ক্লাস্টারের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি করেন। তিনি হলেন মাঠ পর্যায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, যিনি সরাসরি শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং একীভূতকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার কার্যক্রমের উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, একজন সক্রিয় এবং দায়িত্বশীল সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা তার ক্লাস্টারের শিক্ষার মান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন।উদাহরণস্বরূপ BRAC এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সকল উপজেলায় শিক্ষা কর্মকর্তারা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন এবং শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আয়োজন করেন সেখানে শিক্ষার্থীদের আউটপুট তুলনামূলকভাবে বেশি । উপজেলা শিক্ষা অফিসার/ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারগণ সঠিকভাবে মনিটরিং ও শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করে উপজেলার সফলতা নিশ্চিত করতে পারেন।
শিক্ষকমণ্ডলী সকল শিশুর প্রতি সমান ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করে, সমস্যাগ্রস্ত শিশুর পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে একীভূত শিক্ষার সাফল্য অর্জনে যত্নবান হতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে তাদের অগ্রগতি মূল্যায়ন, শিখনবান্ধব
বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং স্থানীয় সরকার, বিভিন্ন NGO এবং অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় সাধন করে জরিপ, পরিকল্পনা ও অর্থায়ন এবং কারিগরি সহায়তায় সমন্বয় করা। প্রাথমিক শিক্ষায় একীভূতকরণ একটি বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার সাফল্যের জন্য সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্র এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা অপরিহার্য। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন এবং সকল স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই সংশ্লিষ্ট সকলের সার্বিক সহযোগিতা আর আন্তরিকতা থাকলে প্রাথমিক স্তরে একীভূত শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের মাধ্যমে সার্বজনীন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক:মোঃ সোহাগ আলম
উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ,
আশাশুনি, সাতক্ষীরা।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)