অপমান সইতে না পেরে যুবকের আত্মহত্যা
রঘুনাথ খাঁ ঃ শালিসী বৈঠকে স্ত্রীকে ভাড়া বাসায় রেখে সংসার না করলে পিটিয়ে পা ভেঙে দেওয়ার হুমকির প্রতিবাদ করায় বাবাকেও গালিগালাজ করার অপমান সহ্য করতে না পেরে এক নির্মাণ শ্রমিক গলায় দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে আম গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। বুধবার ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের আস্কারপুর গ্রামের এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে।
নিহতের নাম আরিফুল ইসলাম নয়ন (২৫)। সে দেবহাটা উপজেলার আস্কারপুর গ্রামের মোঃ রেজাউল ইসলাম গাজীর ছেলে।
মৃত আরিফুল ইসলাম নয়নের বাবা মোঃ রেজাউল ইসলাম গাজী জানান, ২০২১ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে তার ছেলে নির্মাণ শ্রমিক আরিফুল ইসলাম নয়নের সঙ্গে কালিগঞ্জ থানাধীন নলতা ইউনিয়নের মাঘুরালী গ্রামের মোহাম্মদ আলীর নাতনি ও খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কোড়াকোটা গ্রামের জিয়াদ আলীর মেয়ে জান্নাতুন্নেছার বিয়ে হয়। বর্তমানে তাদের জিসান নামের আড়াই বছরের এক পুত্র সন্তান রয়েছে। ১৮ বছর আগে জিয়াদ আলী স্ত্রী অন্দুলাকে তালাক দিলে একমাত্র সন্তান জিন্নাতুন্নেছাকে নিয়ে মাঘুরালি গ্রামের বাবা মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে থাকতো। বিয়ের এক বছর পার না হতেই জান্নাতুন্নেছা তার স্বামীকে নিজের পরিবারের ও আত্মীয় স্বজনদের পরিবারের নারী সদস্যদের বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে বিরোধ করতো। বিষয়টি তিনি জান্নাতুলকে বুঝিয়েছেন কয়েক বার। এরপরও অভাবের সংসারে প্রতিনিয়ত ঝগড়াঝাটি করতো জান্নাতুন্নেছা। একপর্যায়ে জান্নাতুন্নছা পরিবার থেকে অন্য কোথাও ঘরভাড়া নিয়ে থাকার জন্য নয়নের কাছে বায়না ধরে। নয়ন বাবা- মাকে ছেড়ে অন্যত্র যেতে রাজী না হওয়ায় ১৯ দিন আগে বাপের বাড়িতে চলে যায়। একপর্যায়ে এক সপ্তাহ আগে জান্নাতুল নলতা ইউনিয়ন পরিষদে তার উপর নির্যাতনের অভিযোগ করে। নোটিশ পেয়ে তিনি ছেলে ও প্রতিবেশী জিয়াদ শেখ, আরিজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী বৈদ্য, মিজান গাজী, জিয়াদ আলী গাজীসহ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় নলতা ইউনিয়ন পরিষদে যান। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শালিসি বৈঠক শুরু করেন ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান। সেখানে জান্নাতুন্নেছার পক্ষে তার মা, ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। জান্নাতুন্নেছার পক্ষে তার মা ও নয়নের পক্ষে নয়ন ও নয়নের মায়ের কথা শোনেন চেয়ারম্যান। দুপুর একটার দিকে নয়ন ও তাকে কোন কথা বলার সূযোগ না দিয়ে চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান এখনই স্ত্রী জানাœতুন্নেছাকে নিয়ে এক সপ্তাহ পর অন্যত্র ঘরভাড়া করে সংসার করার নির্দেশ দেন। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে চেয়ারম্যান নয়নকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি (রেজাউল) নিজে কথা বলতে গেলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন চেয়ারম্যান। একপর্যায়ে জান্নাতুন্নেছাকে নিয়েই বাড়িতে আসেন তারা।
রোকেয়া খাতুন জানান, ছেলে ও পুত্রবধু মঙ্গলবার দুপুর দুটোর দিকে বাড়ি আসে। এরপর থেকে সে চেয়ারম্যানের হুমকি ও বাবাকে অপমানের কথা নিয়ে বার বার প্রলাপ বকছিল। রাতে সে খাবার খায়নি। তবে রাত ৯টার দিকে কয়েক মিনিটের জন্য ঘরে এসে চলে যায়। ভোরে হাবিবুর রহমান গাজীর আমগাছের ডালে দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় নয়নের লাশ দেখতে পায় প্রতিবেশী বাহার আলী গাজীর স্ত্রী হালিমা খাতুন। খবর পেয়ে বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। সকাল ১১টার দিকে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল খালেকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে জান্নাতুন্নেছাকে তার মা ও মামা সাদ্দামের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
রেজাউল ইসলাম গাজী ওরফে রেজা অভিযোগ করে বলেন, নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান শালিসী বৈঠকের নামে তার ও ছেলের উপর যে মানষিক নির্যাতন ও অকথ্য গালিগালাজ করেছে তা সহ্য করতে না পেরে নয়ন আত্মহত্যা করেছে। তিনি নয়মের মৃত্যুর জন্য চেয়ারম্যানকেই দায়ি করেন।
মৃত নয়নের মামা শ্বশুর সাদ্দাম হোসেন বলেন, তার ভাগ্নি জান্নাতুন্নেছাকে শ্বাশুড়ি প্রায়ই শারীরিক নির্যাতন ও গালিগালাজ করতো। এ নিয়ে কয়েকবার শালিস বিচারও হয়েছে। ১৮ দিন আগে জান্নাতুন্নেছাকে মারপিটের খবর বাড়িতে যান। তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে এমন দৃশ্য দেখে তাকে রাত ১০টার দিকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরে ভাগ্নি পরিষদে অভিযোগ করলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন এসে ১০ দিনের সময় নিয়ে যায়। এরপর মঙ্গলবার শালিসি বৈঠকে তার বোন আন্দুলা, ভাগ্নি জান্নাতুন্নেছা, নয়ন ও নয়নের মা রোকেয়ার কাছে বিস্তারিত জানেন। একপর্যায়ে নয়নকে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে যেতে বলেন। এক সপ্তাহের পর নয়নকে অন্যত্র বাসা নিয়ে স্বস্ত্রীক বসবাস করত বলেন। তবে শালিসী বৈঠকের সময় সাদ্দাম পরিষদের পাশে ছিলেন বলে দাবি করে বলেন, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক নয়।
এ ব্যাপারে নলতা ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি কলটি রিসিভ করেননি।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ আসাদুজ্জামান জানান, প্রাথমিকভাবে নয়ন আত্মহত্যা বলে মনে করা হচ্ছে।
দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ হযরত আলী জানান, এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। নয়নের লাশের ময়না তদন্তের জন্য বুধবার সকালে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে