সুন্দরবনে ফের বেপরোয়া বনদস্যুরা

মোঃ আলফাত হোসেন: সুন্দরবনে দীর্ঘদিন পর আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। এতে জীবিকা নির্বাহ নিয়ে শংকায় পড়েছেন বনজীবীরা। চিন্তিত হয়ে পড়েছে গোটা উপকূলবাসী।
তাঁদের দাবি, গত কয়েক বছর সুন্দরবনে দস্যুদের তৎপরতা ছিল না বললেই চলে। এতে বনজীবীরাও ছিলেন স্বস্তিতে। কিন্তু সম্প্রতি পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে আবারো দস্যুতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে মুক্তিপণের দাবিতে বনজীবীদের অপহরণের কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। বনদস্যুদের নতুন নতুন বাহিনীর খবর এখন সবখানে। ধারালো অস্ত্র ও বন্দুক নিয়ে তারা হামলে পড়ছে বনজীবীদের ওপর। করছে জিম্মি।বনদস্যুদের এসব বাহিনী জেলেদের জিম্মি করে যেমন মুক্তিপণ আদায় করছে, তেমনি তাদের চাঁদা না দিয়ে সুন্দরবনে মৎস্য আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেদের কাছ থেকে জানা যায়, সুন্দরবনে মৎস্য আহরণে যাওয়া জেলেদের কাছ থেকে মাছ, টাকা, মুঠোফোনসহ সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে ডাকাতেরা। এমনকি বনে ঢুকলে জেলেদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের চাঁদাও দাবি করছে দস্যুরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, আত্মসমর্পণকৃত ‘মঞ্জু বাহিনী’ ও জেল থেকে পলাতক আব্দুল্লাহ ‘আব্দুল্লাহ বাহিনী’ নামে সুন্দরবনে দস্যুতা শুরু করেছে।
স্থানীয় একটি সূত্রে জানা যায়, জেল থেকে পলাতক বনদস্যু বাহিনী প্রধান আব্দুল্লাহ সুন্দরবনের আতঙ্ক হয়ে উঠেছেন। জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের আকবর তরফদারের ছেলে আব্দুল্লাহ তরফদার (৪২) গত ১৪ জুলাই নারী পাচার মামলায় জেলে যায়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙচুর হলে সেখান থেকে পালিয়ে কৈখালী ইউপির পারাণপুর গ্রামে তার এক নিকট আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নেন আব্দুল্লাহ।
৬ আগস্ট রাতে স্থানীয় কয়েকজন দুষ্কৃতিকারীর সহযোগিতায় মিরগাং মোড় দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন তিনি। ফের গড়ে তোলেন আব্দুল্লাহ বাহিনী। তার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জন। যাদের অধিকাংশই কারাগার থেকে পালিয়ে আসা এবং বাড়ি সাতক্ষীরা এবং কালিগঞ্জের মৌতলায় বলে সূত্রটি জানিয়েছে।
বনজীবীদের ভাষ্য, ডাকাত দলগুলো গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সুন্দরবনে ফের দস্যুতা শুরু করেছে। জেল ভেঙে পালানো দণ্ডপ্রাপ্তসহ দাগী আসামিরা সুন্দরবনের তক্তাখালি, চুনকুড়ি, দারগাং, আঠারোবেকী, কাচিকাটা, রায়মঙ্গল, কচুখালী, মামুন্দী নদী এলাকা দিয়ে লুটতরাজ করে চলেছে। ৭-১২ জনের এসব দস্যু বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের বাড়ি খুলনার, সাতক্ষীরা এবং কালিগঞ্জের মৌতলা ও কৃষ্ণনগরে। তারা জেলেদের ধরে নৌকায় যা পাচ্ছে সেগুলো তুলে নিচ্ছে। পুনারায় বনে প্রবেশ করলে মোটা অংকের টাকা নিয়ে প্রবেশ করতে বলছে।
এদিকে আত্মসমর্পণকৃত খুলনার মঞ্জু বাহিনী বিভিন্ন সময় সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিপণের দাবিতে জেলেদের অপহরণ করছে। আর এই বাহিনীর প্রধান হিসেবে মঞ্জু নিজেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।জেলেরা আরও জানান, এসব বাহিনীকে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করছে স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতিকারী। যার যার অধিকাংশ মুন্সিগঞ্জ, হরিনগর ও ভেটখালী বাজার থেকে তাদের এসব মালামাল পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া চুনকুড়ি গ্রামের কাঁকড়া জেলে নজরুল ইসলাম জানান, গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সকালে চুনকুড়ি নদীর ধানুখালি এলাকা থেকে ২জন ডাকাত আমাকে তুলে নেয়। আমার সাথে থাকা অন্য জেলেদেরকে মুক্তিপণের টাকা দেওয়ায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। যেদিন আমাকে তুলে নিয়েছে ওই দিন থেকে তারা আমার উপর বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন চালায়। রবিবার (৩ নভেম্বর) সকালে ফরেস্টাররা অভিযান চালিয়ে আমাদেরকে উদ্ধার করে।
হরিনগর গ্রামের মফিজুর রহমান জানান, গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) দুপুরে তাকে সুন্দরবনের তক্তাখালী এলাকা থেকে দুইজন বনদস্যু তুলে নেয়। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে পাঠানোর জন্য বাকি জেলেদেরকে ছেড়ে দেয়। রবিবার (৩ নভেম্বর) সকালে বন বিভাগের ফাইবার বোট দেখে ২ জন বনদস্যু সুন্দরবনের উপর উঠে বন বিভাগের উপর গুলি ছুড়তে শুরু করে। বন বিভাগের সদস্যরা আমাদের নিরাপদ জায়গায় রেখে বনদস্যুদের ধাওয়া করে। পরে বন বিভাগের সদস্যরা আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা গণমাধ্যমকর্মী পীযূষ বাউলিয়া পিন্টু মনে করেন, সুন্দরবনে দস্যুদের আত্মসমর্পণের সুযোগ করে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা ও পুনর্বাসনের পদক্ষেপ ছিল বেশ প্রশংসিত। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, নজরদারি ও তদারকির অভাবে সুন্দরবনে আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়ে গেছে। জেল পলাতক আসামিরা এসব দস্যুদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতে সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার বনজীবী জেলেরা ফের আতঙ্কে ভুগছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে অবশ্যই সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে।
এ বিষয়ে গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান জি.এম মাসুদুল আলম বলেন, সম্প্রতি সুন্দরবনে কয়েকটি বনদস্যু বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ খবর জানার পর আমাদের এলাকার বনজীবী মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এ.জেড.এম হাছানুর রহমান বলেন, বনদস্যুদের বিষয়ে আমি শুনেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)