ফসল উৎপাদনে বদলে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি

আশিকুজ্জামান লিমন:প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষি প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা এবঙ জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা বর্তমান সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের কারণে আজ প্রকৃতি বিপন্ন । প্রাণি, বৃক্ষ, লতা-পাতা, লবন পানির চিংড়ি ঘের, ঘনঘন নদীর ভেড়িবাধ ভাঙ্গন, সুপেয় পানি সংকট, কর্মসংস্থান অভাব, কৃষি জমি সংকট, খাল দখল, সুন্দরবন নির্ভরশীল মানুষের উপরে নিজের পেশা পরিবর্তন করে বিকল্প পেশায় ঝুঁকি বাড়ানো ও সংস্কৃতি হারিয়ে ভয়াবহ বিপন্নতার পথে। বর্তমানে মানুষের এসব কর্মকান্ডের কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ যা ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর। এর ফলে প্রকৃতি নির্ভর মৌসুম ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার উপর পড়ছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব, যা আমাদের দেশের মত প্রকৃতিনির্ভর আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। দেশের কৃষকদের পক্ষে ঋতুভিত্তিক ফসল চাষ পঞ্জিকা অনুসরণ করে ফসল চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বন্যা,খরা নদীভাঙ্গন, লবনাক্ততা, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রতিনিয়ত সামাল দিতে হচ্ছে। বেশী উৎপাদনের নামে কৃষকের ফসলের জমি আজ রাসায়নিক সার-বিষের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে, যার ফলে কৃষিজমি হারাচ্ছে উর্বরতা, উৎপাদন ক্ষমতা।উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শন ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৃষকরা স্থানীয় প্রযুক্তি, নিজস্ব জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও মাল্টিলেয়ার পদ্ধতিতে এক জমিতে একসঙ্গে একাধিক ফসল উৎপাদনের ফলে বদলে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি। কৃষকের পুনর্বাসন ও প্রণোদনা, ফসল উৎপাদন এবং তদারকি বাড়ায় বর্তমানে চাহিদার অতিরিক্ত খাদ্য শস্য উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছেন উপকূলীয় এলাকার কৃষকেরা। সরকার উপকূলীয় অঞ্চলের ঘেরের আইল, পতিত ও লবণাক্ত জমিতে বহুমুখী ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করায় এর সুফল পাচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। যার ফলে শ্যামনগর উপজেলার ১২ টি ইউনিয়নে খালের পাড়, বসত ভিটা, পতিত জমি, কৃষকের ঘরের চাল, ও মৎস্য ঘেরের বেঁড়িতে শোভা পাচ্ছে লাউ, ঢেঁড়স, করলা, মিষ্টি কুমড়া, তরমুজ, বরবটি, শিম, ঝিঙ্গা, কুমড়া, পেঁপে, শসা, পুঁইশাক, সহ নানা ধরনের সবজি।কৃষি অফিসের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মৌসুম ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও বিনা মূল্যে সার ও বীজ প্রদান করে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। ফলে বর্ষাকালীন শাকসবজির উৎপাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বারসিক উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের সাথে নানা ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। বারসিকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা পেয়ে এখন নিজেরাই নিজেদের পারিবারিক খাদ্য পুষ্টি বাগান তৈরি করছেন। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা কৃষিতে কৃষি বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করছেন। এরমধ্যে উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের কর্নধর মন্ডল, আব্দুস সালাম, সায়মা খাতুন, কনিকা রানী পরিত্যক্ত ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের পাত্র ও মাটির পাত্র যত্রতত্র সংগ্রহ করে মৌসুম ভিত্তিক সবজি ও ঘেরের আইলে বিভিন্ন প্রকার সবজি বানিজ্যিক ভাবে উৎপাদন করেছেন৷ পাশপাশি নিজের পরিবারের চাহিদা পুরন করে ফসল বিক্রিও করছেন। মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কচুখালী গ্রামের ভোলানাথ মন্ডল, মঞ্জুরুল ইসলাম, জেলে খালি গ্রামের রাকেশ মন্ডল,তুলসি রানী বর্ষাকালীন তরমুজ, লাউ, করলা, শসা, সহ বিভিন্ন ধরনের সবজি ঘেরে আইলে চাষ করেছেন। রমজাননগর ইউনিয়নের ভেটখালী, টেংরাখালী গ্রামের আমেনা বেগম, নার্গিস পারভিন বর্সাকালীন বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছেন। তবে সফল কৃষকরা জানান, আমরা সরকারী সহায়তার পাশাপাশি বিশেষ করে বারসিকের সহায়তা ও প্রশিক্ষন পেয়ে নিজেরা নিজেদের জ্ঞান ও বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করতে পারছি। আমাদের আগে ফসল চাষে খরচ বেশি হত কারন আমরা ফসল চাষে রাসায়নিক সার কীটনাশক বেশি পরিমানে ব্যবহার করতাম বর্তমানে আমরা রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব বালাই নাশক ও সার ব্যবহার করছি ৷ ফলে আমাদের ফসল চাষে খরচ কমে যাছে। আবার এইসব জৈব সার ও বালাইনাশক নিজেরা তৈরীও করছি। বীজের চাহিদা পুরনের পাশাপাশি বাড়িতে বীজও সংরক্ষন করছি।এছাড়া উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট এলাকার শামীম ওসমান,শীলতলা গ্রামের চিত্ত রঞ্জন গায়েন,মিতা রানী মন্ডল,তেরকাঠি গ্রামের অল্পনা রানী মিস্ত্রি, শ্রীফলকাটির কিশোরী মোহন বৈদ্য, গোবিন্দ মন্ডল সহ আরো কৃষকরা নিজ বাড়িতে বিভিন্ন প্রজাতির সবব্জি বাগান গড়ে তুলেছেন। তাদের বাড়িটি এক একটি শিখন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। এই বাড়িতে এলে কৃষকরা দেখার পাশাপাশি শিখতে পারবেন। সাম্প্রতিক সময়ে তেরকাটি গ্রামের অল্পনা রানী মিস্ত্রি কৃষিতে নিরব বিপ্লব ঘটিয়ে ডেইলি ষ্টার, সিটি গৃুপ প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার অর্জন করেন।শ্যামনগর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি অফিসার জামাল হোসেন বলেন, আমাদের বৈজ্ঞানিকরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন৷ এ অঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। উদ্ভাবিত কার্যকরী প্রযুক্তিগুলো মাঠ পর্যায়ে দ্রুত জনপ্রিয় করতে প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতা ও ফসলের জাতগুলোর উপযোগিতা যাচাইয়ের পর পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। ফসল নিবিড়তায় কৃষিতে বৈচিত্রতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। দেশের দক্ষিণপশ্চিাঞ্চলের লবণাক্ততা মোকাবেলা করে চাষ উপযোগী সবজি, ফল, ডাল, আলু, তরমুজ, গম, ভুট্টা উৎপাদন বাড়ানো ও কৃষকদের আয় বাড়ানোর পথ সহজ হবে। আগামীতে এ প্রকল্পের আওতায় জমির বহুমুখী ব্যবহারে আবাদ আরও সম্প্রসারিত হবে।বারসিকের প্রোগ্রাম অফিসার বাবলু জোয়ারদার বলেন, দুই যুগ আগেও উপকূলীয় এলাকার জমিতে একটি ফসল হতো।বছরের অধিকাংশ সময় কৃষিজমি পতিত অবস্থায় থাকত। এখন সেসব জমিতে তিন থেকে চারটি ফসল উৎপাদন হচ্ছে। আবার একই জমিতে স্থানীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে একসঙ্গে একাধিক ফসলও চাষ হচ্ছে। এভাবে জমির বহুমুখী ব্যবহার ও ফসল চাষে রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার কমিয়ে ফসল চাষ করার ফলে বদলে যাচ্ছে উপকূলের কৃষকের ভাগ্য।

বারসিকের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার বলেন, উপজেলার কৈখালী ভেটখালী মুন্সিগঞ্জ চন্ডিপুর ও ভামিয়া গ্রামের কৃষকরা ঘেরের আইলে তরমুজ সহ বিভিন্ন সবজির ফলন খুব ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ৷ তিনি আরো বলেন, তারা এক ফসলি জমিতে এখন বহু ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করেছেন। চিংড়ি ঘেরের আইলে অফসিজন তরমুজ চাষ করে সফলও হয়েছেন। আমরা তাদের সব সময় সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি ৷

 

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)