ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন

ডেস্ক নিউজ:

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে এই সরকারের মেয়াদের বিষয়টি। বাংলাদেশের সংবিধান কিংবা কোনো আইনে এই সরকার ও এর মেয়াদ সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। যে কারণে সরকারের মেয়াদ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

এমন পরিস্থিতিতে গত শনিবার নতুন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সরকারের মেয়াদ নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করার জন্য যতদিন থাকার দরকার হবে, অন্তর্বর্তী সরকার ততদিন থাকবে।

নতুন সরকারের আরো দু’জন উপদেষ্টা এ নিয়ে কথা বললেও তাদের মেয়াদ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এই ধরনের সরকার কাঠামো সংবিধানের কোথাও নেই, যে কারণে তাদের মেয়াদের কথা কোথাও বলা নেই।

আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, যখন ওনাদের মনে হবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে তখন ওনারা নির্বাচনের ঘোষণা দিবেন। তার আগে এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোন ধারণা পাওয়া যাবে না।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন এই সরকারে কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়াও নতুন অনেক মুখ রয়েছেন। আছে ছাত্র প্রতিনিধিরাও। যে কারণে এই সরকারকে কাজ দেখে মূল্যায়নের কথা বলছেন বিশ্লেষকরা।

সরকারের মেয়াদ নিয়ে যে সব প্রশ্ন?
শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর তিন দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন সরকার ছিল না। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত বৃহস্পতিবার রাতে শপথ নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা।

এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চেয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেদিনই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পক্ষে বৃহস্পতিবার মত দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ।

বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অস্তিত্ব নিয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। যে কারণে এর মেয়াদের বিষয়টিও কোথাও উল্লেখ নেই।

সংবিধানের ১২৩ (৩) (খ) ধারা অনুযায়ী, মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

১২৩ এর ৪ ধারায় বলা হয়, কোনো দৈব দুর্বিপাকে ভোট করা না গেলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, এমন পরিস্থিতি হতে পারে এমন জায়গা থেকে সংবিধানের মধ্যে থাকা হয়তো উচিত ছিল। এমন কিছু না থাকায় এই সরকারের মেয়াদ নিয়েও কিছু বলা হয়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সব ক্ষেত্রে সংস্কারের দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতাদের। কিন্তু সেটি না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন মেয়াদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত সংস্কারে। সংস্কার করতে যত সময় লাগবে সেটা তারা করবেন। সেই সময় তারা নিবেন।

সরকার চায় সংস্কার, বিএনপির দাবি ভোট
গত মঙ্গলবার অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৃহস্পতিবার দায়িত্ব নেয় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর আগেরদিন বুধবার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দ্রুতই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানান।

এর পরই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে কি-না নতুন সরকার। কিংবা তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে কতদিন সময় নিবে।

শনিবার সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা মানুষের আছে। সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা এবং নতুন নির্বাচনের আকাঙ্খার মধ্যে সমন্বয় করে যতদিন থাকা দরকার ততদিন আমরা থাকব, বেশিও না কমও না। যে দায়িত্বের জন্য আমরা আসছি, সেগুলো পালনের চেষ্টা করব।

এছাড়া নাগরিক ঐক্য, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করা হয়েছে।

তবে আগের দিন শুক্রবার উপদেষ্টা কমিটির প্রথম বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা সবাই যাতে দেশে একটা গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করতে পারি, সেটার প্রস্তুতির জন্য এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যেটুকু সময় দরকার শুধু সেটুকু সময়ই আমরা নেব।

নতুন সরকার নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া?
বৃহস্পতিবার অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন তারা।

নতুন সরকারে একদিকে যেমন আছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, আইন বিশেষজ্ঞ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার। তেমনি অন্যদিকে আছেন ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিরাও।

এরই মধ্যে আদালত, আইনশৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেকেই আবার নিজ থেকে পদত্যাগও করেছেন।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্ব দিলেও আরো কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, নতুন সরকারে যারা দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই নতুন মুখ। তারা কাজ শুরু করার কিছুদিন পর তাদের নিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে। তবে আপাতত সবক্ষেত্রে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর বিষয়টিতেই গুরুত্ব দিতে হবে তাদের।

বিশেষ করে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার দিন সারাদেশের পুলিশের থানাগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বিক্ষোভকারীদের হামলা ভাঙচুরে। নতুন করে সেগুলো ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। অনেক থানায় নতুন করে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় দায়িত্ব নিয়ে নতুন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রতিটি সেক্টরে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন সরকারের প্রথম বৈঠকে।

শুক্রবার বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, সব সেক্টরের সংস্কার নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এভাবে চলে না, চলতে পারে না, সিস্টেমটা আমাদের বদলাতে হবে। এ জন্য সমাজের সবার সঙ্গে কথা বলা হবে।

যেভাবে ফিরল অন্তর্বর্তী সরকার
গণ আন্দোলনের মুখে সেনা শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করেন ১৯৯০ সালে। এরশাদ পদত্যাগের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠন হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরশাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতেই সাহাবুদ্দীন আহমদকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করা হয়েছিল।

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ঐ সময়ে প্রথমে উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে সাহাবুদ্দীন আহমদ উপ-রাষ্ট্রপতি হন। এরপর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলে সে পদে বসেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তার অধীনের নির্বাচনে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একতরফা নির্বাচনে মাধ্যমে সরকার গঠন করে। ঐ নির্বাচন বাতিল ও সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালুর দাবিতে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল। সারাদেশে তীব্র আন্দোলনের পর ঐ নির্বাচন বাতিল করে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৯৬ সালের মার্চে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ঐ বছরের ১২ জুন সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

২০১১ সালে এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক বলে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ঐ বছরের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নবম সংসদ। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একতরফা প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। যে কারণে এই অবস্থায় তিন দশক পর আবারো গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)