মাছের ঘের ভিত্তিক সবজি চাষ – সিসডো বাংলাদেশ!

নিজস্ব প্রতিনিধি:
জলবায়ু পরিবর্তন হলো বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এবং চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হলো অন্যতম। বাংলাদেশ হলো ঘন জনবসতি পূর্ণ একটা দেশ। দেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং লবনাক্ততার কারণে কৃষি ব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে, কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষক বর্তমানে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলা হলো বাংলাদেশের একেবারে উপকূলীয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা। এই এলাকা গুলোতে প্রতিনিয়ত লবনাক্ততার পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই পরিপেক্ষিতে এই এলাকা গুলোতে সনাতন পদ্ধতি ও প্রচলিত ফসলগুলো ঠিকমতো উৎপাদন হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত কৃষক অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, কৃষকের জন্য জীবনধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দারিদ্রতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, মিঠা পানির অভাব দেখা দিচ্ছে, ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া থেকে ঝরে যাচ্ছে, শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

 

ছবি:-মাছের ঘেরে করলা, বরবটি ও সিমের চাষ

উপকূলীয় এই অঞ্চল গুলোতে লবনাক্ত জলের কারণে প্রচুর পরিমানে মাছের চাষ হয়ে থাকে। জমির চারপাশে মাটি দিয়ে উঁচু করে এর মধ্যে মাছ চাষ করা হয়ে থাকে, এটাকে এই এলাকায় মাছের ঘের বলা হয়ে থাকে। একটা মাছের ঘেরের চারপাশের মাটি দিয়ে উঁচু এই অংশটিকে আঞ্চলিক ভাবে বলা হয়ে থাকে ঘেরের আইল অথবা ঘেরের ভেড়ি। মাছ চাষের সাথে সাথে কৃষকেরা মাছের ঘেরে সবজি চাষ শুরু করেছে। খুব অল্প খরছে কৃষকেরা মাছের এই ঘেরে সবজি চাষ করে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।

ছবি:-মাছের ঘেরে করলার ভালো ফলন হয়েছে

কৃষকেরা প্রথমে মাছের ঘেরের/আইলের চারপাশে বাঁশ, খুঁটি এবং জালের নেট দিয়ে মাচা তৈরী করে নিয়ে থাকে। তারপরে সামান্য জৈব সার দিয়ে বীজ বপনের জন্য মাটি প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। মাটি প্রস্তুত করে তারপরে বীজ বপন করা হয়ে থাকে। মাছের ঘেরে কৃষকেরা করলা, বরবটি, সিম, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, পেঁপেসহ বিভিন্ন শাকসবজির চাষ করছে। ঘেরের আইলের মাটি অনেক উর্বর হওয়ায় সবজির ভালো ফলন পাচ্ছে কৃষক। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের শোভনা গ্রামের কৃষক মিষ্টার অমল মল্লিক গত ৩/৪ বছরের মত এবারো মাছের ঘেরে সবজি চাষ করেছেন। সিসডো (সোশ্যাল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) সংস্থার পক্ষ থেকে সরেজমিনে গিয়ে আমরা দেখতে পায়, কৃষক অমল মল্লিক এবার মাছের ঘেরে মাছ চাষের সাথে সাথে ঘেরের আইল/ভেড়িতে করলা, বরবটি ও সিমের চাষ করেছেন। কৃষক অমল মল্লিক বলেন, গত সপ্তাহ থেকে করলা ও বরবটি ওঠা শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে তিনি ৮০ কেজি করলা ও ২০ কেজির মত বরবটি বিক্রয় করেছেন। তিনি বলেন, বাজারে এখন সবজির ভালো দাম ও পাওয়া যাচ্ছে। কৃষক অমল মল্লিক বলেন, আগামী ১০/১৫ দিন পর থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫০০ থেকে ৬০০ কেজির মত করলা উঠবে। সফল কৃষক অমল মল্লিকের দেখাদেখি আশেপাশের অনেক কৃষক মাছের ঘেরে সবজি চাষ করে এখন অনেক স্বাবলম্বী হয়েছেন। এবং অনেক দারিদ্র কৃষক এখন মাছের ঘেরে সবজি চাষ করতে আগ্রহী ও উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। আর একজন কৃষক মিষ্টার সংকর মল্লিক বলেন, আগে শোভনা গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ শুধুমাত্র মাছ চাষের সাথে জড়িত ছিলো কিন্ত এখন অনেকেই মাছের ঘেরে মাছ চাষের সাথে সাথে সবজি চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন খুলনা শহরে যে সবজি পাওয়া যাচ্ছে তার অধিকাংশই এই শোভনা গ্রামের। শোভনা গ্রামের এই সবজি এখন খুলনা শহর ছেড়ে ঢাকাতেও যাচ্ছে। কৃষক অমল মল্লিক বলেন এই বছর ঘেরের হারি সহ তার টোটাল খরছ হয়েছে ৭৫,০০০/= টাকার মতো। তিনি আশা করছেন, মাছ ও সবজি বিক্রয় করে সকল খরছ বাদ দিয়েও তার ১,৫০০০০/২,০০০০০ টাকার মত লাভ হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবনাক্ততা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষক যেখানে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও আত্মসামাজিকভাবে জীবনমান উন্নয়নে এই মাছের ঘেরে সবজি চাষ হতে পারে এক অসাধারন দৃষ্টান্ত। এরই মধ্যে সিসডো (সোশ্যাল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) সিএসএ-৩ ফর্মুলা প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছে। ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার, ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিট্যুরিজম, ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রোফরেস্ট্রি (সিএসএ-৩) প্রোজেক্টের মাধ্যমে সিসডো টেকসই কৃষি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।

                                                                                                                     ছবি:-মাছের ঘেরে বরবটির ফলন এসেছে এবং সিম গাছে ফুল এসেছে       

মাছের ঘেরে সবজি চাষ করে সফল এই কৃষকদের সাথে নিয়ে “মাছের ঘের ভিত্তিক সবজি চাষ” এই প্রোকল্পটি আরো বৃহৎ পরিষরে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র ও দারিদ্র কৃষকদের মধ্যে বাস্তবায়ন করার জন্য সিসডো পরিকল্পনা করেছে। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট এই অঞ্চল গুলো হলো সুন্দরবনের গাঁ ঘেষে একেবারে উপকূলীয় অঞ্চল। এই এলাকার মানুষজন জলবায়ু পরিবর্তনের দারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ। উন্নত ট্রেনিং এবং বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে “মাছের ঘের ভিত্তিক সবজি চাষ” এই প্রকল্পটি যদি ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে এই অঞ্চলের মানুষজনের জীবনমানের উন্নয়ন হবে বলে সিসডো বিশ্বাস করে। টেকসই কৃষি, সামাজিক প্রভাব, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং ক্ষুদা মুক্ত বিশ্ব গড়তে এসডিজি বাস্তবায়ন করাই হলো সিসডো এর মূল লক্ষ্য। সিসডো এর “মাছের ঘের ভিত্তিক সবজি চাষ” এই প্রোকল্পটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম কোনো প্রোজেক্ট।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)