শ্যামনগরে যুধিষ্ঠির মন্ডলের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ: হামলাকারিদের মিথ্যা মামলার একদিন পর নির্যাতিতদের মামলা রেকর্ড
নিজস্ব প্রতিনিধি:
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালি ইউনিয়নের গোনা গ্রামের যুধিষ্টির মন্ডলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে আটজনকে পিটিয়ে জখম, সোনার গহনা লুট ও গোয়ালঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অবশেষে মামলা হয়েছে। সুপদ মন্ডলের দায়েরকৃত ২৩ এপ্রিলের এজাহারটি বুধবার শ্যামনগর থানায় ৩৭ নং মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
অপরদিকে গোনা গ্রামের নজরুল চৌকিদারের বাড়িতে কাল্পনিক হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও মারপিটের ঘটনায় ২৫ এপ্রিল যুধিষ্ঠির মন্ডলের ছেলে শ্রীপদ মন্ডল, সুপদ মন্ডল, কৃষ্ণপদ মন্ডল, বিষ্ণুপদ মন্ডল ও জামাতা ভূষণ মন্ডলের নামে থানায় ৩৫ নং মামলা রেকর্ড হওয়ায় নির্যাতিত যুধিষ্টির মন্ডলের ছেলেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
বুধবার সকালে গোনা গ্রামে যেয়ে দেখা গেছে যুধিষ্ঠির মন্ডলের বাড়ির ফটক থেকে গোয়ালঘর পর্যন্ত আগুনে পুড়ে গেছে। বাতাসে পোড়া গন্ধ ভেসে আসছিল। বাড়িতে পুরুষ বলতে ৯২ বছরের বৃদ্ধ যুধিষ্ঠির মন্ডল, তিন ছেলের স্ত্রী ও তাদের চারটি ছোট বাচ্চা অবস্থান করছে। ২৩ এপ্রিল বিকেলে মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে বাড়িতে হামলা চালানোর সময় লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল ভেঙে দেওয়া হয়েছে দেখিয়ে ৯২ বছর বয়সী যুধিষ্ঠির মন্ডল বলেন, হাতের বুড়ো আঙুল ভেঙে দেওয়ার পর তাকে লাথি মেরে পুকুরের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি পাহারা দিতেই তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেননি। ঘটনার বর্ণনাকালে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদের শ্যামনগর শাখার সভাপতি অনাথ মন্ডল, সাধারণ সম্পাদক উৎপল মন্ডল, বাংলাদেশ সনাতন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠণিক সম্পাদক মনদ্বীপ মন্ডল, সাংবাদিক মৃনাল হোসেন প্রমুখ।
শ্রীপদ মন্ডলের স্ত্রী স্মৃতি রানী মন্ডল বলেন, ১৬ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে প্রতিবেশি জাহের চৌকিদারের পুকুরে স্নান করতে গেলে তার ছেলে অনিমেষকে লক্ষ্য করে ইট ছুঁড়ে মারে জাহের চৌকিদারের ছেলে হারুন। এ নিয়ে অনিমেষকে মারপিট ও পুকুরে ডুবিয়ে মারার একপর্যায়ে তিনি ছুঁটে গেলে তাকেও এলোপাতাড়ি মারপিট করে জাহের চৌকিদারের স্ত্রী মর্জিনা খাতুন, মেহেন্দীনগর গ্রামের দ্বীন আলী চৌকিদার, শহীদুল ইসলাম চৌকিদার, গোনা গ্রামের নূর ইসলাম চৌকিদার, রবিউল চৌকিদার, হারেজ গাজী ও মনিরুল ইসলাম চৌকিদারসহ চার/পাঁচজন। এ ঘটনায় পরদিন তার স্বামী বাদি হয়ে থানায় ২২ নং মামলা করেন। পুলিশ নুরুল চৌকিদার ও মনিরুল চৌকিদারকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানোয় মামলা তুলে না নিলে তাদেরকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া অথবা হত্যা করে লাশ কালিন্দি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকির ঘটনায় তার স্বামী শ্রীপদ মন্ডল ১৮ এপ্রিল থানায় ৯১৬ নং সাধারণ ডায়েরী করেন। মামলার আসামী ও তাদের স্বজনদের হুমকি ধামকিতে তারা একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ২৩ এপ্রিল দুরমুজখালি বিজিবি ক্যাম্পের পাশ থেকে তার স্বামী সাইকেলে করে ড্রামে জল আনার সময় আসামী নুরুল চৌকিদারের বাড়ির সামনে আসা মাত্রই তাকে তাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করা হয়। জীবন বাঁচাতে সে সাইকেল ও জলের ড্রাম ফেলে দৌড়ে বাড়িতে ঢোকা মাত্রই একই গ্রামের মতিয়ার চৌকিদার, আব্দুল বারি চৌকিদার, নজরুল চৌকিদার , হামিদ চৌকিদার, রাশিদুল চৌকিদার, আব্দুর রহমান চৌকিদারসহ কয়েজন তাদের বাড়িতে ঢুকে তার স্বামী শ্রীপদ মন্ডলকে লোহার রড দিয়ে মারপিট শুরু করে। বাড়ির অন্য সদস্য সুপদ মন্ডল, তার স্ত্রী দীপিকা মন্ডল, ননদ কবিতা মন্ডল, বিষ্ণুপদ মন্ডল, বিধান মন্ডল ও পারুল মন্ডলকে পিটিয়ে জখম করা হয়। এ সময় তাদের বাড়ি থেকে নগদ টাকা, সোনার গহনা ও জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়। গ্রামে এক ঘর হিন্দুর কোন থাকার দরকার নেই, তোরা ভারতে চলে যা বলে হুমকি দিয়ে আসামীরা চলে যায়। ননদ কবিতার স্বামী ভূষণ মন্ডল একটি হাট থেকে বাড়ি ফেরার সময় তাকেও আসামীরা পথিমধ্যে গোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করে। মতিয়ার ও তার ছেলে আব্দুর রহিম। আশাঙ্কাজনক অবস্থায় শ্রীপদ মন্ডল, সুপদ মন্ডল, দীপিকা মন্ডল, কবিতা মন্ডল, ভূষণ মন্ডলকে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। গভীর রাতে আসামীরা তাদের গোয়ালঘর ও বসত ঘরের একাংশ পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এতে গোয়ালে থাকা সাতটি গরুর মধ্যে একটি আংশিক ঝলসে যায়। প্রতিবেশিরা কেউ তাদের আগুন নেভাতে না আসেনি। অথচ প্রতিবেশিদের মধ্যে অনেকে বলছেন যে ভারতে গেলে জমি যেন তাদের কাছে বিক্রি করা হয়।
স্মৃতি রানী মন্ডল আরো বলেন, ২৩ এপ্রিল বিকেলে আহত আট জনের মধ্যে গুরুতর জখম শ্রীপদ মন্ডল, সুপদ মন্ডল, ভুষণ মন্ডল ও দুই নারীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অথচ তাদের ভর্তির কয়েক মিনিট পর হামলাকারি সাদ্দাম হোসেন, আব্দুর রহিম, নূর ইসলাম চৌকিদারের স্ত্রী হালিমা খাতুন ও নূর ইসলাম রাজুর স্ত্রী মমতাজকে জখম দেখিয়ে ভর্তি করা হয়। ২৩ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৫টায় নজরুল চৌকিদারের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের মিথ্যা অভিযোগ এনে ২৫ এপ্রিল থানায় মামলা দেওয়া হয় তার স্বামীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে। মামলার খবর পেয়ে গ্রেপ্তার এড়াতে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হন তার স্বামী শ্রীপদ ও ভাসুর সুপদ মন্ডল। তবে ননদ এর স্বামী ভুষণের বাম পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় তার পায়ে প্লাস্টার করে ভর্তি রাখা হয়েছে। মামলা করিয়ে দেওয়া ও মানববন্ধনের নামে হিন্দু সংগঠণের কৃষ্ণ উকিলসহ কয়েকজন তাদের সঙ্গে দালালি করেছে বলে অভিযোগ স্মৃতি রানী মন্ডলের। পুলিশকে টাকা না দিলে মামলা হবে না বলে জানান কৃষ্ণপদ উকিল ও স্বপন উকিল।
তবে হযরত আলী, আজগার আলীসহ কয়েকজন এ প্রতিবেদককে জানান, যুধিষ্ঠির মন্ডলের বাড়িতে যে বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়েছে তা একটি সভ্য সমাজের লোকজন মেনে নিতে পারে না।
শ্যামনগর হাসপাতালে গেলে ভুষণ চন্দ্র মন্ডল তার এক্স-রে প্লেট দেখিয়ে বলেন, এখানে থেকে পা ফুল প্লাস্টার করালে তা ভাল হবে বলে তিনি মনে করেন না। কিন্তু তাকে মিথ্যা মামলায় আসামী করা হয়েছে। হাট থেকে ফেরার সময় তার কাছে থাকা টাকা কেড়ে নেওয়ায় কিভাবে চিকিৎসা করাবেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। এ সময় ওই পরিবারের দুই নারী তাদের কানের দুল ছিড়ে নেওয়ার সময় কিভাবে রক্তাক্ত করা করা হয়েছে তা দেখান। একইভাবে একজন তার বাম হাতের হাড় ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখান।
তবে হাসপাতালের ৪ নং কেবিনে থাকা হালিমা খাতুন ও মমতাজ কথা বলার একপর্যায়ে হাসপাতালে প্রতিপক্ষরা বাইরে থেকে তাদের উপর চড়াও হচ্ছে দাবি করে বলেন, তাদের গায়ে কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও ভিতরে জুলে পুড়ে যাচ্ছে। তবে তাদের বাড়িতে বা দেবর নজরুলের বাড়িতে কোন হামলা ও লুটপাটের কথা অস্বীকার করেন মমতাজ বেগম।
এ ব্যাপারে শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বাদল এ প্রতিবেদককে জানান, যুধিষ্ঠির মন্ডল, ভূষণ মন্ডলসহ কয়েকজনের উপর হামলার ঘটনায় হাত ও পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে এটা তার জানা ছিল না। তবে এ ঘটনায় বুধবার মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। নজরুলের মামলাটি নেওয়া ঠিক হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ মামলার কোন আসামীকে গ্রেপ্তার করা হবে না। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে । সাদ্দাম হোসেন, আব্দুর রহিমসহ যারা শ্রীপদ এর মামলায় জেল হাজতে রয়েছে তাদেরকে সুপদ এর মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি। তাংÑ ২৬.০৪.২৩ ছবি আছে।
ছবির ক্যাপশান- শ্যামনগর উপজেলার গোনা গ্রামে যুধিষ্ঠির মÐলের পুড়িয়ে দেওয়া গোয়ালঘরের ছবি।