ইতিহাসের সত্যকে তুলে ধরতে হবে
অনলাইন ডেস্ক :
মার্চ মাস মানেই স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের এই মাসেই একের পর এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেছে। এ মাসেই বাঙালি জাতি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। সে সময় এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেমন প্রকাশ্যে ঘটেছে, তেমনই নেপথ্যেও অনেক ঘটনা ঘটেছে।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জনগণের মেন্ডেট পাওয়ার পর ৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে বলে নির্ধারণ করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে ধরেই নেওয়া হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিটিং শেষে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে, তেজগাঁও বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানই পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী।’ তার এ বক্তব্য পরদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জাতীয় সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনাম হয়েছিল। বাঙালিরাও আশায় বুক বেঁধেছিল, বঙ্গবন্ধু হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ করাকে নিয়ে তখন একটি গুজব শোনা গিয়েছিল। গুজবটি ছিল, ইয়াহিয়া খান নাকি তার আসন ঠিক রাখতেই ঢাকা সফরে এসেছিলেন। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হিসাবে ইয়াহিয়া খান থাকবেন কি থাকবেন না, তা নিশ্চিত করতেই নাকি ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ইয়াহিয়া খান যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সে সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর, ইয়াহিয়া খানের গদি অব্যাহত থাকার ওই গুজবকে অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন। তবে এ কথা ঠিক, গুজব শ্রেফ মিথ্যার ওপর রচিত হয় না। গুজব সব সময়ই কিছু না কিছু সত্য অথবা অর্ধ সত্যের ওপর ভর করে ছড়ানো হয়, যাতে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এ কারণেই গুজব দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ইয়াহিয়া খানের সে সফরের আসল কাহিনি অবশ্য পরে জানা গিয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই পাকিস্তানি জান্তাদের ভেতর ভয় ঢুকে গিয়েছিল যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করবে। তাদের আশঙ্কা ছিল, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংবিধান, ৬ দফার আলোকেই রচনা করবে। যদি তাই হয়, তাহলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থহানি ঘটবে। সে আশঙ্কা থেকেই নাকি ইয়াহিয়া ঢাকা ছুটে আসেন এবং সংবিধানের খসড়ার এক কপিও তাকে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন।
সে সময় নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত তিন সদস্য কমিটির অন্যতম সদস্য ড. জি ডব্লিউ চৌধুরী তার লেখা ‘দি লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘১২ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার সময় আওয়ামী লীগ প্রণীত নতুন শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া তাকে দেখাতে অনুরোধ করেন। শেখ মুজিব তাৎক্ষণিক তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে একমাত্র তারই দায়িত্ব নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করা, অন্য কারও নয়। তিনি আরও বলেন, দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ইয়াহিয়ার এখন একমাত্র কাজ হলো-অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা।’
কিন্তু, ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার পর পর ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত পালটাতে থাকে। বাধভাঙা পানির স্রোতের মতো বাঙালি রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। শুরু হয় এক তরফা অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তী দিকনির্দেশনা দেবেন বলে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণায় পাকিস্তান সামরিক জান্তারা নড়েচড়ে বসেন।
পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানের জেনারেলরা তখন দ্রুত বিভিন্ন সেনানিবাস সফর করা শুরু করেন। তাদের আশঙ্কা ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিতে পারেন। বিভিন্ন সেনানিবাসে ঘুরে ঘুরে কেবল অবাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করেন পাকিস্তানি জেনারেলরা। ৭ মার্চের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের উদ্দেশ্যে পরবর্তী কি কর্মসূচির ঘোষণা দেন সে বিষয়ে আলোচনা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর কী ভূমিকা হবে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশও দেন তারা।
ওদিকে ৭ মার্চের জনসভাকে কেন্দ্র করে ঢাকা সেনানিবাসে পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ৭ মার্চ জনসভার ভাষণে বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তাহলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। জেনারেল খাদিম তার ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’ গ্রন্থে লিখেছেন, শেখ মুজিবের ভাষণের সময় আমি সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও ট্যাঙ্কবহরসহ আমার বাহিনী নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রস্তুত থাকব। শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে বসেন তাহলে আমি আমার অধীন সব শক্তিকে ঢাকা শহরের উদ্দেশে মার্চ করিয়ে দেব। যদি দরকার হয় ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব।
খাদিম হোসেন রাজা তার এ পরিকল্পনার কথা লোক মারফত বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছেও দেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না দিলেও স্বাধীনতার সংগ্রামের আহ্বানের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলার জন্য ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। ওদিকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রহসনের বৈঠক করার জন্য। অপরদিকে পাকিস্তান থেকে বিমানযোগে হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আনা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে আলোচনা চলাকালেই ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর প্রস্তুতি পুরোদমে চলতে থাকে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে চলে যাবার পর পাকিস্তানি হায়নার দল ঝাঁপিয়ে পরে নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালির ওপর। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচার জন্য লাখ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। দেশের এমন পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক নির্দেশনা ছাড়াই বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিকরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিবাহিনী গঠন করে। তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয়, তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল, পুলিশ ও আনসারের বাঙালি সদস্যরা। ছাত্র, কৃষক, চাকরিজীবী ও সর্বস্তরের জনতা একে একে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে লড়াই শুরু করে। অপরদিকে আওয়ামী লীগসহ সব মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীরাও ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ভারতের সাহায্য নিয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার।
তবে প্রবাসী সরকার গঠন করা অত সহজ ছিল না। পদে পদে মতপার্থক্য ও বাঁধা বিপত্তির মধ্যে ঘুরপাক থেকে থাকে প্রবাসী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া। প্রবাসী সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় প্রধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন তৎকালীন যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি। এ বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের লিখিত ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ গ্রন্থে। প্রবাসী বাংলাদেশের সরকার গঠনের তাগাদা আসতে থাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তার লিখিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘সরকার গঠনের জন্য বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে চাপ আসা অব্যাহত রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে তাজউদ্দীন ভাইকে খুবই চিন্তিত মনে হয়।
আমি জানতে চাইলাম, সরকার গঠন করার ব্যাপারে তাজউদ্দীন ভাই দ্বিধাগ্রস্ত কেন? জবাবে তাজউদ্দীন ভাই বলেন, আপনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জানেন না।’ তাজউদ্দীন আহমেদ সেদিন ঠিকই বুঝেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতাদের অনুপস্থিতিতে সরকার গঠন করে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। পরে সরকার গঠন নিয়ে তাই-ই ঘটেছিল।
তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে যেদিন কলকাতায় ফেরেন, তার পরের দিন সন্ধ্যায় কলকাতার লর্ড সিনহা রোডের এক বাড়িতে একটি বৈঠক বসে। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, এএইচএম কামরুজ্জামান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ এবং আরও অনেকে। শেখ মনি তার বক্তৃতায় বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দি, বাংলার যুবকরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে, এখন কোনো মন্ত্রী সভা গঠন করা চলবে না। মন্ত্রী-টন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। সবাইকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে।
রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। এ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে।’ শেখ মনির বক্তব্যের পর এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল যে, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মনে হচ্ছিল, সেখানে উপস্থিত প্রায় সবারই ধারণা ছিল ‘ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ আগেভাগে দিল্লি গিয়েছিলেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য।’ শেখ মনির বক্তব্য শেষে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাদের দিল্লি যাওয়ার সমর্থনে ও শেখ মনির বক্তব্যের বিরুদ্ধে কয়েকটি যুক্তি পেশ করেন।
তিনি এ প্রসঙ্গে তার লিখিত গ্রন্থে এইভাবে উল্লেখ করেন, ‘আইনগত সরকার দরকার। কেননা, আইনগত সরকার ছাড়া কোনো বিদেশি রাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু নিয়োজিত হাই কমান্ডের পাঁচ নেতাকে নিয়ে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের পরিকল্পনা করেছি মাত্র।’ শেখ মনির বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য তিনি আরও দুটো যুক্তি উপস্থাপন করেন। ‘শেখ মনির প্রস্তাবিত বিপ্লবী কাউন্সিল যদি বিভিন্ন মতালম্বীরা দুটি, পাঁচটি বা সাতটি গঠন করে, তাহলে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা কোনোটির আদেশ মেনে চলবে না। তখন কোন্ কাউন্সিলের সঙ্গে বিদেশের সরকার সহযোগিতা করবে।’
শেখ মনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অস্থায়ী সরকার গঠনের বিরোধিতা করে গেছেন। এমনকি একাত্তরের ১০ এপ্রিল শিলিগুড়িতে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দীনের বক্তৃতা রেডিওর মাধ্যমে প্রচারের জন্য যখন তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও শেখ মনিসহ অন্যরা শিলিগুড়িতে অবস্থান করছিলেন, তখন পর্যন্ত শেখ মনি অস্থায়ী সরকার যাতে গঠন না করা হয় সে চেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি তাজউদ্দীনের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে সরকার গঠন না করার জন্য পুনরায় অনুরোধ করেন।
শেখ মনি, আগরতলা গিয়ে দলীয় এমপি, এমএলএ ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সরকার গঠনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। আর এটা না করা হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি পরোক্ষভাবে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অস্থায়ী প্রবাসী সরকার ঠিকই গঠিত হয়েছিল। তাতে শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদদের কোনো সায় ছিল না। তারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরোটা সময় নিজেদের অস্থায়ী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখেছিলেন। এমনকি, প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে তারা মুজিব বাহিনী গঠন করেছিলেন।
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীন বাঙালি যখন লড়াইয়ে লিপ্ত, মুক্তিবাহিনীর অকুতোভয় যোদ্ধারা যখন জীবন বাজি রেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি গান ও মেশিনগানের মুখোমুখি যুদ্ধরত; তখন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কর্মকর্তা জেনারেল উবানের সরাসরি ত্বত্তাবধায়নে বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে উত্তর ভারতের দেরাদুনের কাছাকাছি তানদুয়ায়, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গড়ে তোলে মুজিব বাহিনী। মুজিব বাহিনী নিয়ে পরে অনেক বিতর্কের সৃষ্টিও হয়েছিল। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারা এ নিয়ে অস্তিত্বে ভুগেছেন। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল(পরবর্তী সময়ে জেনারেল) ওসমানীও মুজিব বাহিনী নিয়ে অনেকবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
মার্চের উত্তাল দিনগুলোয় বঙ্গবন্ধু যেমন নানাবিধ চাপের মুখে অটল থেকে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। ছাত্রদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার যেমন চাপ ছিল, তেমনই পাকিস্তান সামরিক প্রশাসন থেকে কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা যাতে না দেন, সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করেছিল। তা সত্ত্বেও, বঙ্গবন্ধু সবদিক সামলিয়ে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের উদ্দশ্যে, ৭ মার্চ এমন একটি দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন, যা সংগ্রামী জনতার পক্ষে বুঝে নিতে এতটুকু সমস্যা হয়নি যে, দেশকে শত্রুমুক্ত করা ছাড়া ঘরে ফিরে যাওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই। ঠিক তেমনই নানাবিধ চাপ ও বাধার মুখে প্রবাসী সরকার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিল।
২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেফতার হয়ে যান, তার অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ যুবলীগের নেতাদের প্রবল বাধা সত্ত্বেও অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করেন, নানারকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও তিনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য শিষ্য হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার এই মহত্তম কাজে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেছেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। অথচ এখন, যখন স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালিত হয় এবং এ দিবস পালনের যে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়; সে অনুষ্ঠান হোক না কোনো মঞ্চে কিংবা বড় কোনো হলে অথবা খোলা কোনো ময়দানে; এসব অনুষ্ঠানে আশ্চর্যজনকভাবে এ চার জাতীয় নেতার নাম খুব কমই উচ্চারিত হয়।
টেলিভিশন, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সবখানেই এ চার জাতীয় বীরকে নিয়ে আলোচনা হয় না বললেই চলে। আমরা একবারও কি ভেবে দেখেছি, এভাবে জাতীয় নেতাদের যদি অবহেলা করি, তাদের প্রকৃত মর্যাদা দিতে না পারি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাহলে আমারা কি দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছি? দিনের পর দিন, তাদের উপেক্ষা করে করে আমরা ইতিহাসের সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি কিনা ভেবে দেখতে হবে। এভাবে আমরা, ইতিহাস বিকৃতির দোষে দোষী হচ্ছি কিনা তাও লক্ষ করতে হবে।
ইতিহাসের সত্যকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা টেকসই হয় না। এভাবে হয়তো সাময়িক তৃপ্তি লাভ করা যায়। তবে সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই। এমন দিন যখন আসবে, সেদিন হয়তো মুখ লুকানোর সময়ও আমরা পাব না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা