প্রেমিককে কাছে ডাকে পাহাড় কন্যা

যতো দূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে অজস্র ছোট-বড় স্বচ্ছ ঝর্ণা, পাখির কলকাকলী আর দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ সব মিলিয়ে সুন্দরের অপূর্ব এক বিশাল ক্যানভাসে যে কোন প্রকৃতি প্রেমিককে কাছে ডাকেন আঁকা বাঁকা উঁচু নিচু পাহাড় কন্যা। আবার কখনো প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারিসারি পাহাড়ি গ্রামগুলো।

বন, পাহাড়, পাথর, ঝর্ণা আর আদিবাসীদের নিজেদের মতো জীবন যাপন সত্যিই মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির অপরূপ মহাসমারোহের এক পরিবেশ। মনকড়া পরিবেশে নিঃশ্বাস নিতে শহরের কোলাহল আর নাগরিক যন্ত্রণা থেকে একটু প্রকৃতি, আলো-হাওয়া, সুন্দরের টানে নির্দ্বিধায় শ শ প্রকৃতি প্রেমিদের পদচারণা ঘটে বকশীগঞ্জের কামালপুরের এ স্পটে।

জামালপুর জেলা পরিষদ ১৯৯৬ সালে ২৬ একর জায়গাজুড়ে পর্যটকদের কথা ভেবে গারো পাহাড়ের চূড়ায় নির্মাণ করেছে পিকনিক স্পট ‌‌ক্ষণিকা। এখানে রাতে থাকার জন্য রয়েছে জেলা পরিষদের একটি ডাকবাংলো। এখানে হিংস্র কোনো প্রাণী নেই। ধানের মৌসুমে সীমান্তের ওপারের গভীর পাহাড় থেকে নেমে আসে ভারতীয় বন্যহাতির দল।

এ পাহাড়ে রয়েছে নানান জাতের অসংখ্য পাখ-পাখালি। পাহাড়ের ভাঁজে-ভাঁজে অবস্থিত লাউচাপড়া, দিঘলাকোনা, বালুঝুড়ি, সাতানীপাড়া, পলাশতলা, মেঘাদল, শুকনাথপাড়া, গারোপাড়া, বালিজোড়া, সোমনাথপাড়া, বাবলাকোনা গ্রামে গারো, কোচ, হাজং আদিবাসীদের বসবাস। এ অঞ্চলের আদিবাসীরা বেশ সহজ-সরল ও বন্ধুসুলভ। ফলে অতি সহজেই ঘুরতে আসা পর্যটকদের সাথে ভাব হয়ে।

প্রতি বছর শীত মৌসুমে এখানে ছুটে আসেন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক। ভ্রমণ পিয়াসী আর পিকনিক করতে আসা অসংখ্য মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে নির্জন-নিভূত এ অঞ্চলটি।

এখানে রয়েছে ভিআইপি মানের দ্বিতল রেস্টহাউস, ছোট পরিসরের তিনটি সাধারণ রেস্টহাউস, কৃত্রিম লেক, পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য বিভিন্ন টিলায় পাকা সিঁড়ি, একটি শিশু পার্ক ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা।

জামালপুর সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে বকশীগঞ্জ উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে পাকা রাস্তায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে এগুলেই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে প্রায় ১০ হাজার একর জায়গাজুড়ে বিশাল পাহাড়ি এলাকা। এখানেই লাউচাপড়া পিকনিক স্পট।

এলাকাটি বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। এলাকাটি জামালপুর জেলার অধীনে হলেও ঢাকা থেকে শেরপুর হয়ে যাওয়া অনেকটা সহজ। ঢাকা থেকে ডে-নাইট বাসে চলে আসতে পারেন শেরপুর। শেরপুর থেকে বাস, সিএনজি, অটো বা ভ্যানে শ্রীবর্দী কর্ণজোড়া হয়ে যাওয়া যায় বকশীগঞ্জের লাউচাপড়া। শেরপুর থেকে লাউচাপড়ার দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। আবার ঢাকা থেকে ট্রেনে জামালপুর জেলা শহরে এসে জামালপুর থেকে সিএনজি বা অটোয় বকশীগঞ্জ হয়ে লাউচাপড়ায় যাওয়া খুবই সহজ।

বকশীগঞ্জের ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বলেন, গারো পাহাড় ভোরে আপনাকে সুপ্রভাত জানাবে অসংখ্য পাখির কলতান। দুপুরে সবুজের উপরে ঢেউ খেলানো চিক চিক রোদ আকর্ষণ করবে। গারো পাহাড়ের ১৫০ ফুট উপরে নির্মিত ৬০ ফুট উঁচু টাওয়ারে উঠলেই এক লাফে চোখের সামনে চলে আসবে দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি সবুজ পাহাড়-টিলা যা মনের গহীনে শীতল হয়ে একাকার হয়ে যায় পর্যটক ও পাহাড়।

পর্যটক কবি কাফি পারভেজ বলেন, টাওয়ারে উঠলেই চোখে পড়বে সীমান্তের ওপারের মেঘালয় রাজ্যের সুবিস্তৃত পাহাড় ছাড়াও তুরা জেলার পাহাড়ি ছোট্ট থানা শহর মহেন্দ মুগ্ধ করবেই। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে অজস্র ছোট-বড় স্বচ্ছ ঝর্ণা আর পাদদেশে রয়েছে স্বচ্ছ লেক। এ পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে নানা জাতের পাখি। চোখে পড়বে কাঠঠোকরা, হলদে পাখি, কালিমসহ অসংখ্য পাখির মেলা। এখানে পড়ন্ত আলোর বিকালটা হয়ে ওঠে অসম্ভব মায়াবি। আর এখানকার পূর্ণিমা রাতের থই থই জোৎস্না আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে স্বপ্নলোকে।

পরিবেশবিদ জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, প্রতি বছরের শুরুতেই নগর কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে ডুবে যেতে এবং সবুজ-সুন্দর আকণ্ঠ পান করতে ভিড় জমে দর্শনার্থীদের। সুন্দরের টানে দলবেঁধে ছুটে পিকনিক পার্টি। নির্জন-নিভৃত এ অঞ্চলে গিয়ে পাহাড়ে কোলে হারিয়ে যায় অসংখ্য প্রেমিক-প্রেমিকা।

অপরদিকে লাউচাপড়া ক্ষণিকা পর্যটন এলাকাকে কেন্দ্র করে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও। এখানে পর্যটকদের জন্য ঘোড়ার গাড়ি, বিশুদ্ধ পানি, শরবত, ডাব, খেলনাসহ নানান সামগ্রী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকেই। তেমনই একজন ফারুক মিয়া। তার সাথে কথা বলে জানা গেল লাউচাপড়া ক্ষনিকা পর্যটন কেন্দ্রে দীর্ঘদিন ধরে খাবার বিক্রি করেন।

ফারুক মিয়া বলেন, ‌পর্যটন মৌসুমে পিকনিক স্পটে অনেক লোকের ভিড় হয়। আমাদের ব্যবসাও ভালো হয়। তবে পিকনিক স্পটটিকে আরো উন্নত করা হলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে এবং আমরা সকলে ভালো ব্যবসা করতে পারবো।

জামালপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, পিকনিক স্পটে বিশুদ্ধ পানিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ছোট ছোট বাংলোসহ বেশ কিছু উন্নয়ন কাজের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের  মধ্যে এসব কাজের বাস্তবায়ন করা হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)