আজ বিশ্ব প্রবীণ দিবস
অনলাইন ডেস্ক :
কেউ কর্মসূত্রে প্রিয় মা-বাবাকে বাড়িতে রেখে বিদেশে আছেন। কেউ দেশেরই বড় কোনো শহরে চাকরি বা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। বৃদ্ধ মা-বাবাকে সময়ই দিতে পারছেন না। অপর দিকে অন্দরমহলে থাকা লোকজনও প্রবীণদের খোঁজ রাখছে না। গ্রাম থেকে শহরের অনেক স্থানেই এমন চিত্রে দেখা মিলবে। অর্থ-সম্পদ, সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলে-মেয়ে থাকার পরও অনেক প্রবীণ মা-বাবার স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। এমন সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও ক্যালেন্ডার ধরে দিনটি এসেছে, চলেও যাবে। রয়ে যাবে প্রবীণদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনায় ভরা দিনগুলো। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘পরিবর্তিত বিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির সহনশীলতা’। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। ‘বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ’-এ গিয়ে প্রবীণদের অবস্থান-পরিস্থিতির একটি অংশ চোখে পড়েছে।
শুক্রবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রবীণদের একাকিত্ব-বেদনা। এমন চিত্র নিশ্চয় সমগ্র দেশের নয়, কিন্তু যেসব প্রবীণ পরিবার-সন্তান দ্বারা এমন বর্বরতার শিকার হয়েছেন, এদের সোনালি স্বপ্ন কে ফিরিয়ে দেবে। জীবন যৌবন শেষ করে যে সন্তানদের মানুষ করেছেন, তাদের অনেকেই এদের এখন বেমালুম ভুলে গেছেন।
প্রতিষ্ঠানটির ছোট্ট একটা বারান্দায় লোহার প্রাচীরে থুতনি লাগিয়ে কী যেন ভাবছিলেন প্রায় নব্বই বছর বয়সি এক বৃদ্ধ। তার রুমটি খোলা। কাছে যেতেই কিছুটা রাগতস্বরে বললেন, কে? এই প্রতিবেদক নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একসময় ওই বৃদ্ধ বললেন, তার সবই ছিল বাড়ি-গাড়ি, সম্মান-ক্ষমতাও। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রকৌশলী ছিলেন। দুই ছেলে, এক মেয়ে। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ছেলেরা আমেরিকা থাকেন, মেয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কথার ফাঁকে হঠাৎ শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, ‘আমার এখন কেউ নেই। ছেলেরা স্ত্রী-সন্তান, শ্বশুড়-শাশুড়ি নিয়ে প্রবাসে থাকেন।
বারান্দায় বসে কাপড় সেলাই করছিলেন এক শিক্ষিকা। রাজধানীর নামকরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। এক ছেলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। দুই মেয়ে দেশেই আছেন। স্বামী মারা গেছেন দেড় যুগ আগে। স্বামী বিদ্যুৎ বিভাগের বড় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ঢাকায় বহুতল বাড়ি থাকলেও তার স্থান হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। বললেন, অবসর ভাতার কিছু টাকা থাকায় এখনো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছেন।
কষ্ট পেলেও কাঁদেন না। কাঁদেন না মানে? ‘মা-বাবা সন্তান দ্বারা কষ্ট পেলে, সেই মা-বাবা যদি চোখের পানি ফেলে, সন্তানদের অমঙ্গল হয়। তাই কাঁদি না, সন্তান সব সময় যেন ভালো থাকে। কিন্তু, একটি বারের জন্য খবরও পাই না, আমার সন্তানরা কেমন আছে।’ সন্তানের জন্য মায়ের কী আকুতি, ওই সময় তার চোখ মুখই স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল।
প্রতিষ্ঠানটিতে তার মতো আরও ১৭ জন বৃদ্ধা নারী রয়েছেন। বৃদ্ধ পুরুষও আছে সমপরিমাণ। এদের মানসিক যন্ত্রণার, কষ্টের যেন শেষ নেই। ছেলে-বৌমা নাতি নাতনিদের দেখতে সবসময় ব্যাকুল থাকেন। এই বয়সে এসে মানুষ সঙ্গ চান, গল্প করার মানুষ চান। নিজের সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলা করে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা কি কখনো বৃদ্ধাশ্রমে মেলে। এমন প্রশ্ন প্রায় সবার।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘অনেককেই বলতে শোনা যায়, ছেলে-মেয়েরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কি দেশে পড়ে থাকবে। সবাইকে ছেড়ে বিদেশেই তো থাকতে হবে। এখন পুরোনো যুগ নেই-আধুনিক যুগ। তাই মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রম কিংবা কোনো প্রবীণ হোমে রাখতে হচ্ছে। এমনটা যারা ভাবেন-বলেন, তাদের বলতে চাই-আমরা যারা মা-বাবা ছিলাম, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরি করেছি। দেশ-বিদেশ ঘুরেছি। আমরা কি আমাদের সন্তানদের, শিশু-আশ্রম, শিশু হোমে দিয়েছিলাম?
বৃদ্ধাশ্রম কিংবা প্রবীণ হোমে থাকাদের বয়সজনিত নানা রোগ বাড়ছে। অনেকেই মৃত্যবরণ করছেন। কারও লাশ স্বজনরা নিচ্ছে, কারও দাফন-কাফন হচ্ছে স্বজনবিহীন। আবার বহু বয়স্ক মানুষ আছেন, যাদের মাথার ওপর ছাদও নেই। এই বয়সে ঘুরে ঘুরে এদিক ওদিক জীবন ধারণ করছেন। পরিবারের লোকজন যদি প্রবীণদের না দেখে বা কোনো প্রবীণদের পরিবারে যদি কেউ না থাকে, তাহলে সরকারকেই তার দায়িত্ব নিতে হবে। অপর দিকে যৌথ পরিবার যত ছোট্ট হচ্ছে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তত অসহায় হয়ে পড়ছেন। বলছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান। তার ভাষ্য, সন্তানদের যেন অর্থবিত্তের মধ্যে রেখে শুধু শিক্ষিত করা না হয়। সুশিক্ষায় মানুষ করে মানবিকভাবে গড়ে তুলতে হবে।
রাজধানীতে বসবাস করেন এমন প্রায় একডজন প্রবীণের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাজ থেকে হঠাৎ অবসর প্রবীণদের নিঃসঙ্গ করে দেয়। অনেকেই একা থাকেন, তাতে মানসিক অবসাদের সম্ভাবনা থাকে। বিগত সময়ে করোনা মানসিকতাকে আরও অস্থির করে তুলছে। এদের কণ্ঠেই উঠে এলো, শহরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অনেক রয়েছে কিন্তু এই প্রবীণদের পাশে কোনো সংগঠনকে সক্রিয় ভূমিকা পালনে দেখা যায় না। সবাই ভাবে বৃদ্ধ মানেই খরচের খাতায়। কারণ বৃদ্ধদের জন্য যে যত্নের প্রয়োজন তা সবাই দিতে পারে না। এটা প্রবীণদের কাছে লজ্জার।
২০২২-এর জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯। তারা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২২ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। তথ্য বলছে, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। প্রবীণ জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বেশি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে দুই কোটি। আর ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে চার কোটিতে।