আগের পেশায় ফিরতে পারেননি দেড় কোটি
অনলাইন ডেস্ক :
দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার চকবাজারে শিশুদের খেলনার ছোট একটি দোকান ছিল শওকত আলীর। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর দোকান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু করোনার পুরো সময় তাকে প্রতিমাসে ভাড়া গুনতে হয়েছে। শওকত আলী জানান, ভাড়া পরিশোধ করে এবং বকেয়া পাওনা না পেয়ে দোকানটি ছেড়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। তিনি এখন বেকার। প্রতিদিনের সংসার চালানো তার জন্য এখন কঠিন বিষয়। করোনাভাইরাসের ধাক্কায় শওকত আলীর মতো ৩ কোটি ৫৯ লাখ মানুষ কাজ হারানোর এমন তথ্য উঠে আসে এক সমীক্ষায়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন। তাদের বড় একটি অংশ পুনরায় মূলধারায় ফিরতে পারেনি। বর্তমানে অনেকেই বেকার আছেন। এছাড়া অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। এই অর্থনীতিবিদের মতে, এখন সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আকার আরও বাড়ানো এবং কর্মসূচির অর্থ সুষ্ঠুভাবে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে।
করোনায় অনেক লোক কাজ হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বেকার হয়েছে অনেকে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বেশি। এদের পুনর্বাসনের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে সরকারকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ। তিনি বলেছেন, গ্রামে যেসব ক্ষুদ্র প্রকল্প নেওয়া আছে সেগুলো বন্ধ করা যাবে না। এসব ক্ষুদ্র প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
আবুল বারাকাতের গবেষণায় দেখা যায়, করোনার সময় যেসব খাতে কাজ হারিয়েছে মানুষ, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সেবা খাতে। এ খাতে কর্মহীন হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ মানুষ। এটি মোট কর্মহীনের ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। কৃষি খাতে কর্মহীন হয়েছে ১ কোটি ১৩ লাখ (৩১.৭ শতাংশ), শিল্প খাতে ৯৩ লাখ (২৫.৮ শতাংশ)।
মোটা দাগে উল্লিখিত তিনটি খাতে কর্মহীন মানুষের উপখাত হিসাবে গবেষণায় তুলে এনেছেন। উপখাতের মধ্যে করোনায় কাজ হারিয়েছেন খনিজসম্পদ ও খননকাজে প্রায় ৭৩ হাজার জন। এছাড়া উৎপাদনমুখী কারখানার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৬৩ লাখ; বিদ্যুৎ, গ্যাস ও এয়ারকন্ডিশন খাতে প্রায় ৬১ হাজার এবং নির্মাণ শ্রমিক সাড়ে তিন লাখ।
এছাড়া পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা আছেন ৪৩ লাখ, পরিবহণ ও মজুত খাতে ৩৭ লাখ, বাসস্থান ও খাদ্য সেবা কাজের সাড়ে ১০ লাখ শ্রমিক ও উদ্যোক্তা কর্মহীন হয়েছেন। আর তথ্য ও যোগাযোগ খাতে সোয়া লাখ, আর্থিক ও বিমা কর্মকাণ্ডে জড়িত ২ লাখ ৩৬ হাজার, রিয়েল এস্টেট কর্মকাণ্ডে ১ লাখ ও শিক্ষা খাতে প্রায় ২০ লাখ এবং অন্যান্য সেবায় জড়িত ১৭ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। আর এসব কর্মহীন লোকের মধ্যে আগের পেশায় ফিরতে পারেনি প্রায় ৪০ শতাংশ।
বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেছেন, করোনায় অনেক মানুষ জীবন-জীবিকা হারিয়েছেন। পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে অনেকে ফিরতে পারেননি আগের জায়গায়। অনেকের খারাপ অবস্থা থেকে গেছে। তাদের আগের পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য সহায়তা দরকার। আর সেটি করতে হবে অর্থনীতি সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে। তা হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আর কর্মসংস্থানের সুযোগ যাতে গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য তাদের সহায়তা করতে হবে।
আগের পেশায় ফিরতে পারেনি : নোয়াখালীর চাটখিল পাঁচগাঁও গ্রামের মো. সেলিম ঢাকার মহাখালীতে একটি গাড়ির পার্টসের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। মা ও বোনকে নিয়ে রাজধানীর হাজারীবাগে বসবাস করতেন। কিন্তু করোনায় কাজ খুইয়ে বেকার হয়ে পড়েন। তিনি জানান, আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি আগের পেশায় ফিরতে পারেননি।
রাজধানীর বনানীতে একটি বাসাবাড়িতে প্রাইভেট কারচালক ছিলেন শাকিল। করোনায় তার চাকরি চলে যায়। শাকিল জানিয়েছেন, এখনো তিনি বেকার। মাঝেমধ্যে রাজধানীর বেড়িবাঁধে দৈনিক ভিত্তিতে সুযোগ পেলে অটোরিকশা চালান। কিন্তু সেটিও নিয়মিত নয়।
গৃহকর্মী মমতাজ কাজ হারিয়েছেন করোনার সময়। করোনার শুরুতে বাসাবাড়িতে তাকে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তার চাকরি চলে যায়। মমতাজ এখন বেকার।
জানা যায়, করোনার পর কাজে ফিরতে না পারা এসব মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন অনেকে। বিশ্লেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে অর্থনীতিতে একধরনের দুষ্টচক্র সৃষ্টি হবে। যেখানে একজনের স্বল্পব্যয়ের কারণে অন্যের আয় হবে স্বল্প। এটি মানুষের জীবন-জীবিকা উভয়কে অনিশ্চিত করবে। এর ফলে সঞ্চয় হবে না, হলেও হবে অতি স্বল্প। এতে সৃষ্টি হবে বিনিয়োগহীন পরিবেশ অথবা বিনিয়োগ হবে অতি স্বল্প। এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারও কমে আসবে।
সরকারি উদ্যোগ : অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে নানা ধরনের ২৮টি আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ তহবিল ১০ হাজার কোটি, বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণে ৭৭০ কোটি এবং ৩৩ লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ ১৩২৬ কোটি টাকা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কোভিড-১৯ ধাক্কায় অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এখন আগামী দিনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্যবিমোচন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হবে কর্মসংস্থানকে। এমন কিছু পদক্ষেপ থাকবে, যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকনির্দেশনা থাকবে। এছাড়া নগদ আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে ১৫ লাখ পরিবারকে।