মামলার ধীর গতি, চার্জশীটভুক্ত ৩৪জনকে অব্যহতি সাতক্ষীরার আওয়ামীলীগ নেতা হত্যা
রঘুনাথ খাঁ:
সাতক্ষীরা দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠণিক সম্পাদক আবু রায়হানকে জবাই করে হত্যা মামলা চলছে ধীর গতিতে। অভিযোগপত্রে উলেখিত ৭৭ জন আসামীর মধ্যে ৩৪ জনকে অভিযোগগঠণকালে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। ১০ মাস পর সাক্ষী গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। এমতাবস্থায় ন্যয় বিচার পাওয়া নিয়ে হতাশায় ভুগছেন নিহতের পরিবারের স্বজনরা।
নিহত আবু রায়হান(৪৬) দেবহাটা উপজেলার দক্ষিণ পারুলিয়া গ্রামের রকিব গাজীর ছেলে।
আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা জানান, প্রথম দফার মহাজোট সরকারের শেষের দিকে বিশেষ করে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর জামায়াত শিবির নিজেদের অস্বিত্ব রক্ষায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সারা দেশের ন্যয় তারা সাতক্ষীরায়ও আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী, আওয়ামী লীগ অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ মুৃক্তিযুদ্ধের চেতানায় বিশ্বাসী সকল মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের অস্তি¡কে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। দেবহাটার পারুলিয়া আওয়ামী লীগ অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। জামায়াতের দুর্গ হিসেবে পরিচিত গরানবেড়ে, আস্কারপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে যাতে পুলিশ প্রশাসন ঢুকতে না পারে সেজন্য সন্ধ্যার পর থেকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড দিতে শুরু করে জামায়াত শিবির। পাহারা দল তৈরি করে উপস্থিতি টের পেলেই পটকা ফুটিয়ে ও মসজিদে মাইকিং করে পুলিশকে টার্গেট করা শুরু করে। এসব এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে আসামী ধরতে এসে পুলিশ জামায়াত শিবিরের নেতা কর্মীদের দারা আক্রান্ত হয়েছে কয়েকবার। একপর্যায়ে জামায়াত শিবিরের কাছে শুধু আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা নয়, সাধারন মানুষও জিম্মি হয়ে পড়ে। আগামি ১০ম সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করার অন্যতম কৌশল হিসেবে ত্রাস সৃষ্টি করতে হরতালের নামে সহিংসতা সৃষ্টি করে পাঁচপোতা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আজিজ ও দক্ষিণ পারুলিয়া গ্রামের শ্রমিক লীগ নেতা আলমগীর হোসেনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে তারা।এ অবস্থায় আবু রায়হান জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে দলীয় নেতা কর্মীদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তার অবস্থানের ফলে পারুলিয়া বাজার এলাকায় জামায়াত শিবির আঙুল তুলে কথা বলতে পারতো না। আওয়ামী সংগঠণের মধ্যে ভয় ঢোকাতে কয়েক মাস আগে তারা যুবলীগ নেতা ফারুক হোসেন রতনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। এ ঘটনায় মামলা না করায় আওয়ামী লীগের দুর্বলতা হিসেবে ওই দলের সাধারন নেতা কর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। একপর্যায়ে কুলিয়া, গরানবেড়ে, আস্কারপুর, চালতেবেড়ে, কালীগঞ্জের ইন্দ্রনগর, সন্ন্যাসীর চক ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার কয়েকজন জামায়াত শিবিরের নেতা গোপন বৈঠক করে রায়হানকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বৈঠকে রায়হান দেবহাটার অপ্রতিরোধ্য হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে যেকোন মূল্যে সরিয়ে দেওয়ার নীল নকশা তৈরি করে। এরই মধ্যে রায়হানের ঘনিষ্ট বলে পরিচিত দক্ষিন পারুলিয়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে মেহেদী হাসান সম্প্রতি ডাঃ শহীদুল আলমের হাত ধরে বিএনপিতে যোগ দেওয়ায় বিরোধী দলের লোকজন আরো প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে ওঠে। ওই সময়ে তারা রায়হানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ভাঙচুর করে। এরই জের ধরে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর বৃহষ্পতিবার রাত ৮টার দিকে পারুলিয়া বাসস্টাণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মোমেনা বস্ত্রালয়ের সামনে কয়েক’শ লোকের উপস্থিতিতে জামায়াত, শিবির ও ব্নিপির নেতা কর্মীরা ফিল্মি স্টাইলে রায়হানকে নৃশংসভাবে কুপিটয়ে ও জবাই করে হত্যা করে। এ হত্যাকাÐের মোটিভ ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে তারা নিহতের পরিবারের সদস্য ও দলীয় নেতা কর্মীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করে হত্যা মামলা ভেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। যদিও দেরীতে হলেও তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২২ নভেম্বর কর্তব্য অবহেলার দায়ে দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেরামত আলীকে প্রত্যাহার করা হয়। পরদিন নিহতের মা জাহানারা খাতুন বাদি হয়ে কারো নাম উলেখ করে দেবহাটা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কয়েক দিনের মধ্যে পুলিশ দেবহাটার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ৩০ জনেরও বেশি জামায়াত শিবির ও বিএনপি’র নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করে।
সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, রায়হান হত্যা মামলায় পারুলিয়া গ্রামের সামছুল গাজীর ছেলে ইব্রাহীম হোসেন ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ও কোড়া গ্রামের আকবর আলী সরদারের ছেলে আব্দুলাহ আল মামুন বিচারিক হাকিম গোলাম নবীর কাছে রায়হান হত্যাকাণ্ডে নিজেদের জড়িত থাকিার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। নয় জন তদন্তকারি কর্মকর্তা পরিবর্তণ হয়ে ১০ম তদন্তকারি কর্মকর্তা দেবহাটা থানার উপপরিদর্শক উজ্জল কুমার দত্ত ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে ৭৭ জনের নাম উলেখ করা হয়। এর মধ্যে নয়জন পলাতক রয়েছে। মামলাটি বিচারের জন্য সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে স্থানান্তর করা হয়।
মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী অ্যাড. অজয় কুমার সরকার ও মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. ইউনুছ আলী জানান, করোনা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে মামলার গতি মন্থর হয়ে যায়। গত বছরের ১৪ সেপ্ম্বের অভিযোগ গঠণের জন্য দিন ধার্য করা হয়। মামলা থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য ৫৭ জন আবেদন করেন। ধার্যদিনে উভয়পক্ষের শুনানী শেষে সকল আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠণ করা হবে বলে তারা জানতেন। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কজ লিস্টে তারিখ না পড়ায় ও অভিযোগগঠণ সম্পর্কে জানতে না পারায় তারা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। মামলার কার্যক্রমে যথাযথ অগ্রগতি না হওয়ায় জজ কোর্টের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২০ মার্চ মামলাটি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে বদলী হয়ে আসার কয়েকদিন পর তারা জানতে পারেন যে ৩৪ জন আসামীকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ গঠণের ১০ মাস পর আগামি ১৮ জুলাই সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য করা হয়। যথাসময়ে আসামীদের অব্যহতির বিষয়টি জানতে না পারায় তারা ওই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে পারেননি। ফলে নিহতের পরিবার ও আইনজীবীরা এ মামলায় ন্যয় বিচার পাওয়া নিয়ে হতাশায় ভুগছেন।
অভিযোগগঠণকালে অব্যহতি পাওয়া আসামীরা হলেন, দিদার আলী সরদারের ছেলে সাদ্দাম হোসেন ও ফারুক হোসেন, ইসমাইল গাজীর ছেলে ফারুক হোসেন, মাসুম বিলাহ, আরিজুল ইসলাম, আমীর আলীর ছেলে রওশান আলী, ইবাদুল হক ওরফে ইবাদুর রহমান, সরাফরাজ হোসেন সরদার ওরফে রাজ, আমজাদ বিশ্বাস, বাবর আলী, খায়রুল বাসার, আনারুল হোসেন, হাসান আলী, মনিরুল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান গাজী ওরফে মুকুল, আব্দুল করিম সরদারের ছেলে ফারুক সরদার, আবছার আলী, হায়াত আলী, হায়দার আলী, আব্দুলাহ সরদারের ছেলে ওমর ফারুক, মাওলানা রুহুল আমিন সরদার, আবু হুরাইরা মোলা, মাদার মোলা ওরফে ব্যাং সরদারের ছেলে ফারুখ হোসেন, সাইফুলাহ, নুর মোহাম্মদ সরদার, রেজাউল গাজী, নজরুল ইসলাম ওরফে নজু, খায়রুল গাজী, অঅবু তালেব বুলবুল, শেখ বাহাদুরের ছেলে শেখ রওশান, সাহাজুল সরদার, ইমাদুল সরদার ও কামরুল ইসলাম।
অব্যহতির আদেশে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক মোঃ শরিফুল ইসলাম উলেখ করেন যে, ২৮ জনের এজাহারে নাম নেই বা সন্দেহ করা হয়নি। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনিদ্দিষ্ট কোন অভিযোগ নেই। আসামীদের বিরুদ্ধে ৩০২/৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠণ করার মত কোন উপাদান পরিলক্ষিত হয় নাই। কাজেই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করিলাম। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৬৫(সি) ধারায় দরখাস্ত মঞ্জুর করা হলো। তাদেরকে মামলা থেকে অব্যহতি দেওয়া হলো। ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠণ করা হলো। অভিযোগ গঠণ কালে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত পিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অ্যাড. মিজানুর রহমান(চালতেতলা)।
জানতে চাইলে নিহত আবু রায়হানের স্ত্রী শাহীনা খাতুন বলেন, একটি স্পর্শকাতর হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠণে ৩৪ জনকে অব্যহতি দেওয়ার ১০ মাস পর সাক্ষীর জন্য দিন পড়েছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। তার স্বামী আবু রায়হানকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে জখম করার পর জবাই করে হত্যা মামলায় এ অবস্থা হলে সাধারণ মানুষের জন্য বিচার কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে?
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ -২য় আদালতের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, শুধু এ মামলা নয়, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১ম আদালতে থেকে স¤প্রতি স্থানান্তর হওয়া ১৭০টি মামলার কার্যক্রম যাতে দ্রুত চলে সেজন্য রাষ্ট্রপক্ষ তৎপর থাকবে। ৩৪ জনকে অব্যহতি দেওয়ার ব্যাপারে কোন আইনগত দিক আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে।