লিভারে অতিরিক্ত চর্বি কেন জমে, কী করবেন?
অনলাইন ডেস্ক :
ফ্যাটি লিভার বর্তমান সময়ের একটি জটিল রোগ। লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমলে সেটিকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়। যাদের ওজন বেশি, ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিস আছে, তাদের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
মানবদেহে যকৃত বা লিভার একটি অত্যাবশ্যকীয় গ্রন্থি যা পেটের ডানপাশের উপরিভাগে বুকের খাঁচার নিচে অবস্থান করে। লিভার আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক কাজ সম্পন্ন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রক্তের বিষাক্ত পদার্থগুলো পরিশোধন করা, পিত্তরস তৈরি ও নিঃসরণ করা যা ফ্যাট বা চর্বিজাতীয় খাবার হজম ও খাদ্যনালি থেকে শোষণপ্রক্রিয়ায় সাহায্য করে, আমিষ তৈরি করা, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখে, রক্তের ঘনত্ব ও জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া অক্ষুণ্ন রাখে ইত্যাদি।
লিভারের কোষগুলোতে শতকরা পাঁচ ভাগের মতো চর্বি থাকে, যা স্বাভাবিক, কোনো কারণে অতিরিক্ত চর্বি জমা হলে তাকে ফ্যাটি লিভার রোগ বলা হয়। ফ্যাটি লিভার দুই ধরনের হয়, অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (এ এফ এল ডি) যা দীর্ঘদিন ধরে অধিক পরিমাণে মদ্যপানের ফলে ঘটে ও সঠিক পদক্ষেপ (বিশেষত মদ্যপান থেকে বিরত থাকা) না নেওয়া হলে এটি থেকে দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগ অর্থাৎ লিভার সিরোসিস হতে পারে।
অন্যটি হলো নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (এনএএফএলডি)। যার সঙ্গে সাধারণত ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির আধিক্য ইত্যাদি রোগের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। এই রোগগুলোকে একত্রে মেটাবলিক সিনড্রোম বলা হয়। মেটাবলিক সিনড্রোম না থাকলেও কারও শুধুমাত্র স্থূলতাই বাড়িয়ে দিতে পারে ফ্যাটি লিভারের প্রবণতা। স্থূলতা পরিমাপ করার জন্য বিএমআই বা বডি মাস ইনডেক্স ব্যবহার করা হয়।
একজন ব্যক্তির ওজন কেজিতে এবং উচ্চতাকে মিটার-এ নিয়ে, উচ্চতার বর্গ দ্বারা ওজনকে ভাগ করলে বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই পাওয়া যায়। বিএমআই ১৮.৫ এ নিচে হলে তাকে কম ওজন বলা হয়, ১৮.৫-২৪.৯ হলে তা স্বাভাবিক ওজন, ২৫-২৯.৯ হলে তা অতিরিক্ত ওজন এবং বিএমআই ৩০-এর বেশি হলে তা অতিস্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা বলা হয়। প্রযুক্তির প্রতি অতি নির্ভরশীলতা, শারীরিক পরিশ্রম এর ঘাটতি ও প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ ইত্যাদিকে স্থূলতার কারণ হিসাবেই বিবেচনা করা হয়।
স্থূলতা ও এনএএফএলডি বিগত দশকগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও স্থূলকায় মানুষের দেহেই ফ্যাটি লিভারের প্রবণতা বেশি দেখা দেয়, অনেক সময় রোগা ব্যক্তিরাও ফ্যাটি লিভার-এ ভুগে থাকেন। বিশেষ ধরনের কিছু ওষুধ, অ্যালকোহল, হরমোনজনিত কারণ ও উত্তরাধিকার সূত্রে রোগা ব্যক্তিদের ফ্যাটি লিভার রোগ হতে পারে।
অ্যালকোহল সেবনকারীদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়। তবে গত কয়েক দশকে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণ সঠিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত না হওয়া ও অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন করা।
নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বা এনএএফএলডি কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো সাধারণ ফ্যাটি লিভার যাতে লিভারে বাড়তি চর্বি থাকলেও পরীক্ষা নিরীক্ষায় লিভারে প্রদাহ বা ক্ষতির কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
অন্যটি হলো নন-অ্যালকোহলিক স্টেটো-হেপাটাইটিস বা ন্যাশ যাতে চর্বিজনিত কারণে লিভার প্রদাহ বা ক্ষতির ব্যাপারটি শারীরিক লক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে।
আমাদের দেশের একটি সমীক্ষায় প্রায় ৩৩ শতাংশ মানুষের দেহে ফ্যাটি লিভার শনাক্ত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে মধ্যবয়স্ক নারীদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
ফ্যাটি লিভার নীরব একটি রোগ যা সাধারণত উল্লেখযোগ্য কোনো উপসর্গ তৈরি করে না। তবে ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভূত হতে পারে, কখনো কখনো পেটের ডানপাশের উপরিভাগে ভোঁতা ধরনের ব্যথাও হতে পারে। ফ্যাটিলিভারের রোগীদের মাঝে যাদের ডায়াবেটিস থাকে তাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগের আশঙ্কা বেশি থাকে। আর যারা নন-অ্যালকোহলিক স্টেটো হেপাটাইটিস বা ন্যাশে ভোগেন তাদের দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহের একপর্যায়ে লক্ষণ প্রকাশিত হতে শুরু করে। ন্যাশে আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৪০ শতাংশের মধ্যে লিভার সিরোসিস (লিভার সংকুচিত হয়ে কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় ও রক্তপ্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি হওয়া) দেখা দিতে পারে।
তবে লিভার সিরোসিস হবার পরও প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত তা সহনীয় পর্যায়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ এই সময়ে রোগী ক্লান্তি, অবসাদ, দুর্বলতা অনুভব করলেও কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ছাড়া লিভার তেমন কোনো জটিলতা ছাড়াই তার কার্যক্রম চালিয়ে নেয়।
এ পর্যায়ে অতিক্রান্ত হলে লিভার সিরোসিসের নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন পেটে, পায়ে পানি আসা, খাদ্যনালিতে শিরা ফুলে গিয়ে স্ফীত শিরা ফেটে রক্তক্ষরণ হওয়া, মস্তিষ্ক ও কিডনির বৈকল্য দেখা দেয়।
এ অবস্থাকে Decompensated liver Cirrhosis বা লিভার সিরোসিসের অসহনীয় অবস্থা বলা হয়। এই অবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। লিভার সিরোসিসের এই পর্যায়ে রোগীর সাধারণভাবে দুই বছর আয়ুষ্কাল থাকে। বর্তমান বিশ্বে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হিসাবে ফ্যাটি লিভারকে গণ্য করা হয়। তবে, ফ্যাটিলিভারে আক্রান্ত রোগীদের কিছুসংখ্যকের লিভার সিরোসিস দেখা দেয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগ শনাক্তের পর সচেতনতার মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারেন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রোগ শনাক্তকরণ
সাধারণত পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম বা অন্যান্য ইমেজিং পরীক্ষা যেমন সিটি স্ক্যান, এম আর আই ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিস (এনএএফএলডি) শনাক্ত হয়।
ফ্যাটিলিভারের সঙ্গে ইনসুলিন প্রতিরোধের একটি সম্পর্ক থাকে। ইনসুলিন, যা রক্তের সুগারকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের বিপাক প্রক্রিয়ায়ও কাজ করে। আর এ রোগীদের ক্ষেত্রে লিভারের কোষগুলোতে ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণে বিপাক প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে কাজ করতে না পারায়, ধীরে ধীরে লিভারের মধ্যে গ্লুকোজ ও চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। রক্তের সুগার ও ইনসুলিন এর মাত্রার পরিমাণ নির্ণয় করে ‘ইনসুলিন প্রতিরোধ’ শনাক্ত করা যায়।
রক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে প্রয়োজনীয় হচ্ছে লিভার এনজাইম যেমন এসজিপিটি, এসজিওটি, বিলিরুবিন, এলবুমিন, রক্তের চর্বির পরিমাণ, রক্তের সুগার; এ ছাড়াও হেপাটাইটিস বি, সি এর সংক্রমণ আছে কিনা তাও পরীক্ষা করতে হয়।
উল্লেখ্য ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, রক্তের চর্বির আধিক্য, স্থূলতার সঙ্গে ফ্যাটি লিভার ঝুঁকির পাশাপাশি হৃদরোগ, কিডনি ডিজিজ, মস্তিষ্কের শিরাজনিত রোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করতে হয় ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও চিকিৎসা সুনিশ্চিত করতে হয়।
দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহের ফলে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত লিভারজুড়ে আঁশ তৈরি হয় যাকে লিভার ফাইব্রোসিস বলা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এই আঁশযুক্ত লিভারে অসংখ্য গুটি তৈরি হয়, এ অবস্থাকে লিভার সিরোসিস বলা হয়। লিভারে প্রদাহ, ফাইব্রোসিস ও সিরোসিস শনাক্ত করার সর্বোত্তম পন্থা হলো লিভার বায়োপসির মাধ্যমে যেখানে একটি বিশেষ সুই এর দ্বারা লিভার হতে টিস্যু পরীক্ষা করে লিভারে সৃষ্ট ক্ষতি পরিমাপ করা যায়। তবে কিছু নন-ইনভেসিভ পরীক্ষা দ্বারা লিভার বায়োপসি না করেও লিভারের চর্বির পরিমাণ ও ফাইব্রোসিসের মাত্রা নিরূপণ করা যায়, এর মধ্যে অন্যতম হলো ফ্রাইবোস্ক্যান। এ পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের অবস্থা চিকিৎসার আগে ও পরে অনুধাবন করা যায়।
ফ্যাটিলিভারের চিকিৎসা
এনএএফএলডি বা ফ্যাটিলিভারের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। কোনো ওষুধ দ্বারাই সরাসরি লিভারের চর্বি নির্মূল করা সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে বেশ কিছু ওষুধ ইতোমধ্যে গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। তবে অনুমোদিত ওষুধ না থাকলেও বেশ কিছু সমীক্ষা ও ট্রায়ালে দেখা গেছে কিছু ওষুধ যা ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগে ব্যবহৃত হয় ও কিছু ভিটামিন (যেমন ‘ই’ ভিটামিন) ফ্যাটিলিভারের প্রদাহ ও ফাইব্রোসিস কমাতে সাহায্য করে। এখন পর্যন্ত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
শরীরের ওজন কমানো (কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ) প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায়। এক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন খুবই জরুরি। শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত, রুটি, পাউরুটি, আলু ইত্যাদি পরিমাণে কম খেতে হবে। শাকসবজি, তাজা ফলমূল স্বাভাবিক পরিমাণে খেতে পারবেন।
পর্যাপ্ত মাছ (তৈলাক্ত অংশ ছাড়া) খেতে পারবেন তবে জাঙ্কফুড, তৈলাক্ত ও ভাজাখাবার, মাংস, চর্বিযুক্ত খাবার ও কেক-পেস্ট্রি, আইসক্রিম ইত্যাদি ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে।
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে; অন্তত ৩০ মিনিট দৈনিক একটু জোরে হাঁটা কার্যকর একটি ব্যায়াম ওজন কমানোর জন্য পশ্চিমা বিশ্বে প্রয়োজনে ব্যারিয়াট্টিক অস্ত্রোপাচার করে পাকস্থলিকে ছোট করে দেওয়া হয়, আমাদের দেশে এটি এখনো প্রচলিত নয়।
ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, রক্তের কলস্টেরলের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করতে হবে।
ফ্যাটিলিভারের কারণে যদি লিভার সিরোসিস ও এর জটিলতাগুলো দেখা দেয়, এ পর্যায়ে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনে লিভার প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে একজন সুস্থ ব্যক্তির লিভারের অংশ রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাপন পুনঃনিশ্চিত করা যায়।
আমাদের দেশে ইতঃপূর্বে কয়েকটি লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে শিগ্গির বাংলাদেশে লিভার প্রতিস্থাপন পুরোদমে শুরু হবে বলে আমরা আশাবাদী। সুতরাং আশঙ্কা নয়, সচেতনতাই জরুরি। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ওজন কমানো, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে ফ্যাটিলিভারের রোগীও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন।