সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস পালিত-ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় অর্জিত হয় স্বাধীনতা

সুভাষ চৌধুরী:
মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৯৭১ এর ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত হয়েছিল উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই দিনটি আমাদের জন্য অনেক গর্বের। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমন ও প্রতিরোধের মুখে সাতক্ষীরা ছেড়ে পাকিস্তানি বাহিনী পলায়ন করেছিল। সেদিনই সাতক্ষীরা মুক্ত ঘোষণা করা হয়।
তারা বলেন, দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে আমরা অনেক শহীদ সন্তানকে হারিয়েছি। আমাদের অনেক মা ও বোনের সম্ভ্রমহানি হয়েছে। এত নির্যাতন সহ্যের পরেও বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিতভাবে অস্ত্র ধরে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে বাঙালি জাতি তার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। আলোচনায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরও বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল তার ওপর ভিত্তি করেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে মানুষ অসংগঠিত অবস্থায় হলেও স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, পেশাজীবি মানুষ ও সাধারণ মানুষ। সাগর পরিমান রক্ত দিয়ে তারা আদায় করেন একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি লালসবুজ পতাকা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব। গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্খাকে সামনে রেখে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করতে ভারতের মিত্রবাহিনী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আমাদের বিজয় অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল। বন্ধুদেশ ভারত কয়েক কোটি মানুষকে ৯ মাস যাবত খাদ্য ও বাসস্থান দিয়ে রক্ষা করা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করেছিল। এর ফসল হিসেবে আমরা বাংলাদেশ লাভ করেছিলাম।
স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। সাতক্ষীরা মহকুমার ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা এসডিও ভবনের পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে সেখানে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড্ডয়ন করেছিল। এর পরেই তারা শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নামেন। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা ট্রেজারি থেকে অস্ত্র ও অর্থ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আর্থিক তহবিল গঠন করেছিলেন এবং ওই অস্ত্র শত্রু মোকাবেলায় ব্যবহার করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরার এই অবদানকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না উল্লেখ করে তারা বলেন, ভোমরা যুদ্ধ, বৈকারির যুদ্ধ, বেলেডাঙার যুদ্ধ, শ্যামনগরের গোপালপুরের যুদ্ধ, ঝাউডাঙার যুদ্ধ, হরিনগরের যুদ্ধ, তালার মাগুরার যুদ্ধ, কলারোয়ার যুদ্ধ, টাউন শ্রীপুর ও পারুলিয়ার যুদ্ধ সহ কমপক্ষে ২০টি যুদ্ধে সাতক্ষীরার দামাল সন্তানেরা অংশগ্রহণ করে এই মহকুমাকে মুক্ত করে। এই প্রসঙ্গে তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শাজাহান মাস্টার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক সোনা, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সম আলাউদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল, শামসুজ্জোহা কাজল, শহীদ আব্দুর রাজ্জাক, এরশাদ খান হাবলু, আবু নাসিম ময়না প্রমুখ যোদ্ধাদের। যারা প্রয়াত হয়েছেন। এছাড়াও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং সম্ভ্রম হারানো মা ও বোনেদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়।
আজ মঙ্গলবার সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস পালন উপলক্ষ্যে সাতক্ষীরার সাংবাদিক ঐক্য মিলনায়তনে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। ৯ মাসের এই মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন এবং যেসব মায়েরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতির সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার আহবান জানান।
স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তীতে আক্ষেপের সাথে তারা বলেন, এখন পর্যন্ত সাতক্ষীরায় কোন স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। জেলার গণকবর ও বধ্যভূমিগুলিও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এসব গণকবর ও বধ্যভূমি গুলি সংরক্ষন করে একইসাথে স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করতে হবে।
সাতক্ষীরার সাংবাদিক ঐক্য’র আহবায়ক সুভাষ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় আরও বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ সুভাষ চন্দ্র সরকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবু আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওয়াজেদ কচি, উন্নয়নকর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মুনসুর আহমেদ, জেলা তাতীলীগ নেতা শেখ আলমগীর হোসেন, সিপিবি’র আবুল হোসেন, জাসদের অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, বাসদের নিত্যানন্দ সরকার, জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড এর সদস্য সচিব লায়লা পারভিন সেঁজুতি, প্রভাষক জাহাঙ্গীর হোসেন ছাড়াও সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ, মিজানুর রহমান, দেশ টিভির শরীফুল্লাহ্ কায়সার সুমন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির আবুল কাশেম, মোঃ মুনসুর রহমান প্রমুখ।
এর আগে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মিলনায়তনে দিবসটি পালন উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)