সাতক্ষীরায় সনাতন ধর্মালম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত প্রতিমা শিল্পীরা। দুয়ারে কড়া নাড়ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এজন্য জেলার মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে দুর্গাপূজার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। ব্যস্ততায় যেন দম ফেলার ফুরসত নেই প্রতিমা শিল্পীদের। তাদের নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে দুর্গা, গণেশ ও কার্তিকসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা।
এ বছর সাতক্ষীরা জেলায় ৫৮১ টি মণ্ডপে উদযাপিত হবে শারদীয় দুর্গোৎসব। তবে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে সরকার নির্দেশিত সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ভক্তরা জানান, এবার দেবীদুর্গা আসবেন ঘোড়ায় চড়ে, আর ফিরবেনও ঘোড়ায়। ঢাক, ঢোল, শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনি দিয়ে দেবীদুর্গাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তারা। প্রতিটি পূজা মণ্ডপে প্রতিমা বানানোর কাজ শেষ। এখন রঙ তুলির আঁচড়ে চলছে শেষ সময়ের প্রস্তুতি। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিমার কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। নিখুঁতভাবে মনের মাধুরি মিশিয়ে তারা প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন। আর এক একটি মণ্ডপে প্রতিমা তৈরিতে কারিগররা মজুরি নিচ্ছেন ৬০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। একইসঙ্গে পূজার পুরোহিত নির্বাচনের কাজও শেষ করছেন মণ্ডপ পরিচালনা কমিটি।
আগামী ১১ই অক্টোবর (সোমবার) ষষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে ৫ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হবে। সাতক্ষীরা সদরসহ জেলার অধিকাংশ মন্দিরে চলছে তারই প্রস্তুতি। ভাস্কররা ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমার সৌন্দর্য বর্ধনে। দুর্গাপূজার বাকি মাত্র ৩ দিন। দুর্গোৎসবকে পরিপূর্ণভাবে সাজাতে মন্দিরগুলোতে দিনরাত চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। তারমধ্যে সদরের মন্দিরগুলোতে চলছে প্রতিমা তৈরীর ধূম।
শরতের শিশির ভেঁজা কাঁশফুলই শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা দেয়।গত বুধবার(০৬ অক্টোবর) শুভ মহালয়া মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব। দুর্গোৎসব ঘিরে নানা আয়োজনে ব্যস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে সব ধর্ম ও শ্রেণির বাঙালির মধ্যেও। পূজার আনন্দে মাতোয়ারা বাঙালি জাতি। মন্দিরে মন্দিরে চলছে প্রতিমা সাজসজ্জার কাজ। দেবী মূর্তি নির্মাণ শেষ, গায়ে রঙ ছোঁয়ানোর অপেক্ষায় দক্ষ ভাস্কর, নিপুণ শিল্পী। ধূলোবালি লেগে নষ্ট হয়, তাই কাপড়ের পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে প্রতিমাগুলোকে। আয়োজকরা ছুটছেন দর্জিপাড়ায়। মা দুর্গার লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ির জরির কাজ, গণেশের ধুতিতে নকশাদার পাড় বসানো আর মহিষাসুরের জমকালো পোশাক তৈরির কাজ। কেউবা ছুটছেন কামারপাড়ায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন দেবীর হাতের চক্র, গদা, তীর-ধনুক ও খড়গ-ত্রিশূল আর ভীষণ ঘষামাজায় মিস্ত্রিরা ব্যস্ত মণ্ডপ গুলোকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে। ডেকোরেটর কর্মীদের ঘুম নেই। আয়োজকদের ফরমায়েশ আর ডিজাইন অনুযায়ী গড়ে তুলছেন পূজামণ্ডপ। চলছে সংস্কারের শেষ কাজটুকু।
বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দুর্গার বাহকসহ প্রতিমার শাড়ি ও অলংকার পরানোর কাজও ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। আলোকসজ্জা ও রঙিন কাগজ দিয়ে সাজান হচ্ছে প্রতিটি মণ্ডপ। প্রতিমা দেখতে এখনই দর্শনার্থীরা মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সাতক্ষীরা সদরে ১০৫টির মধ্যে সরজমিনে সদরের রসুলপুর, আলিপুর, ভোমরা, কাথন্দা, ছয়ঘোরিয়া, সোনাবাড়িয়া, ঝিটকি, ধুলিহর, নলতা, দেবহাটা, বাকা, বুধহাটা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ মন্দিরে দুর্গার আগমন উপলক্ষে ইতোমধ্যে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি আছে রং তুলির আঁচড় লাগানোর কাজ।
এদিকে পলাশপোল সার্বজনিন পূজা মণ্ডলের সভাপতি শম্ভু কুমার দে বলেন, আমাদের পূজামণ্ডপে এবার প্রতীমা তৈরির কাজ করছেন সদরের ব্যাংদহা থেকে আসা কারিগর (মৃৎশিল্পি) মধু দাস ও মৃত্যুঞ্জয় দাশ। তাদের কাছে জানতে চাইলে বলেন, বংশ পরম্পরায় এ পেশায় জড়িত আছে তারা। বাপ দাদাদের কাছেই শেখেন কাদা মাটি আর খড় দিয়ে কিভাবে প্রতীমা তৈরি করতে হয়। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রতীমা তৈরির কাজ শেষ হবে বলেও জানান তিনি।
এখন রঙ আর তুলির আঁচড় দিয়ে দুর্গাকে সাজানো হবে। এদিকে প্রতিমা তৈরির উপকরণের দাম বাড়ছে প্রতি বছরই। তার ওপর পড়েছে করোনার প্রভাব। এমনকি উপযুক্ত পারিশ্রমিকও পাচ্ছেন না তারা বলে দাবি করেন।
অন্যদিকে, ঝিটকি এলাকার কারিগর অজয় পাল বলেন, বছরের সব সময় কাজ থাকে না তাই অধিকাংশ সময় বেকার থাকতে হয়। কিন্তু এখন দুর্গাপূজা উপলক্ষে কাজের চাপ বেশি। তাই রাত দিন পরিশ্রম করে মনের মাধুরী মিশিয়ে মা দুর্গার প্রতীমা তৈরি করছি। এখন থেকে প্রতিমা রং করে দ্রুত শেষ করা হবে।। কাঠ, সুতা, খড়, রং, কাপড় ও মুকুট দিয়ে এক সেট তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় ৮-১০ দিন।
সাতক্ষীর জেলা মন্দির কমিটির সভাপতি বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে তাদের সকল প্রস্তুতি শেষের দিকে।গত মঙ্গলবার( ৫ অক্টোবর) জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এই বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে আলোচনা সভা শেষ হয়েছে। তবে এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে যে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করলে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। এ বছর উৎসবকে শান্তিপূর্ণভাবে করতে প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি মণ্ডপের নিজস্ব সেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলোর তালিকা করে সেখানে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
এবছর সদর উপজেলার ফিংড়িতে-০৯টি, লাবসায়-০৬টি, বল্লীতে-০৫টি, ঝাউডাঙ্গায়-১৮টি, আগড়দাড়িতে-১৩টি, ধুলিহরে-৩টি, ব্রহ্মরাজপুরে-০৪টি, ভোমরায়-০৩টি, শিবপুরে-০৯টি, ঘোনায়-০৬টি, বাঁশদাহে-৪টি, কুশখালি-০৩টি, বৈকারি-০৩টি, ধানদিয়া ১৭টি, নগরঘাটায় ৯টি, সরুলিয়ায় ১০টি, কুমিরা ১৩টি, খলিষখালী ১৯টি, তেতুলিয়া ৮টি, তালা ১৯টি, ইসলামকাটি ২০টি, মাগুরা ১০টি, খলিলনগর ২০টি, খেশরা ১৪টি, জালালপুর ১৬টি সর্বমোট ১২টি ইউনিয়নে ১৮১টি সহ মোট ৫৮১টি মন্ডপে প্রতিমা তৈরীর কাজ চলছে।
এদিকে,আশাশুনি উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ১০৬টি পূজামন্ডপে পূজার আয়োজনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে উৎসবমুখর পরিবেশে। প্রতিমা তৈরী ও মন্দিরের সাজসজ্জার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ১০ অক্টোবর মহাপঞ্চমীতে সায়ংকালে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ১১ অক্টোবর সোমবার মহাষষ্ঠীতে দুর্গাদেবীর ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠী বিহিত পূজা এবং সায়ংকালে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ১২ অক্টোবর মহাসপ্তমীতে নবপ্রত্রিকা প্রবেশ, সপ্তমী বিহিত পূজা এবং দেবীর ঘোটকে আগমন। ১৩ অক্টোবর মহাষ্ঠমীতে দুর্গা দেবীর অষ্টমী বিহিত পূজা। ১৪ অক্টোবর মহানবমীতে বিহিত পূজা এবং ১৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে বিহিত পূজা সমাপন ও বিসর্জন, বিজয়া দশমী কৃত্য ও দেবীর দোলায় গমন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে দুর্গোৎসব বিবেচিত হলেও বর্তমানে তা বাঙালি উৎসবে পরিণত হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশ সাতক্ষীরার অন্যান্য স্থানের মতো আশাশুনিতেও শিল্পের হাতের নকশায় এবং রং তুলির ছোঁয়ায় তৈরী হচ্ছে দেবী দুর্গার প্রতিমা।
আশাশুনি উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ কুমার বৈদ্য জানান, প্রতি বছরের মতো এ বছরেও আশাশুনি উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের সর্বমোট ১০৬টি মন্ডপে শারদীয় দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হবে যার মধ্যে আশাশুনি সদর ইউনিয়নে ১০টি, শোভনালীতে ৬টি, কাদাকাটিতে ১৬টি, দরগাহপুরে ৯টি, কুল্যায় ১১টি, শ্রীউলায় ৮টি, বুধহাটায় ৫টি, খাজরায় ১৪টি, আনুলিয়ায় ৪টি, বড়দলে ২১টি মন্ডপে এ পূজা অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তায় বাঙ্গালী হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে উৎসবের আমেজ বইতে শুরু করেছে। সকল পূজা মন্দিরগুলোতে চলছে প্রতীমা নির্মাণ ও মন্দিরের সাজসজ্জার কাজ। পরবর্তীতে রং তুলির ছোঁয়ায় দশভুজা ষষ্ঠীতে পাবে জীবন্ত রূপ।
দেবী সেজে উঠবে অপরূপ সাজে। শঙ্খ উলুধ্বনি আর মঙ্গল সঙ্গীতে দেবী দুর্গাকে বরণ করে নেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। জাতির মঙ্গল কামনায় সব অশুভ শক্তি বিনাশে প্রতিবছর মহালয়ার দিনে দেবী দূর্গা শ্বশুরালয় থেকে পিতৃগৃহে আগমন করেন। আসুরিক শক্তির বিনাশ আর পার্থিব শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি লাভের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে মা দূর্গার আরাধনা করে আসছেন। করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আশাশুনি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পূজা উপলক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এবার পূজা উপলক্ষে আড়ম মেলাসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানসমূহ হবেনা বলে জানা গেছে। এদিকে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের সহযোগিতায় শারদীয় দুর্গাপূজা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জেলাবাসী।
করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় প্রতিমা দেখতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য সাবান দিয়ে হাতধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে আয়োজক কমিটি। আগামী ১১ অক্টোবর মহাষষ্ঠী এবং ১৫ অক্টোবর বিজয়া দশমী বা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে এবারের শারদীয় দুর্গাৎসব।
এদিকে পূজা মণ্ডপগুলোর নিরাপত্তায় আনসার ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন পূজা বিজিবি, র্যাব,জেলা ও উপজেলা প্রশাসন টহল দেবে বলে জানা গেছে।
শারদীয় দুর্গাপূজার নিরাপত্তার বিষয়ে সাতক্ষীরা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ দেলওয়ার হুসেন বলেন, আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে আমরা সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। যেকোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে আমরা সর্বদা সজাগ রয়েছি। সকল সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে তাদের উৎসব পালন করতে পারে সে বিষয়ে সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় দ্বায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।