করোনাকালে সাতক্ষীরার আলীপুর স্কুলের ৫০ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ!

অনলাইন ডেস্ক :

করোনাকালে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় নানা অজুহাতে সাতক্ষীরা সদরের আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ ছাত্রীর বাল্য বিবাহ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ এমনটাই জানিয়েছেন।

তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা না এলেও প্রশাসনিক কাজে মহামারির এই দেড় বছরে প্রায় নিয়মিত স্কুলে গেছেন মো. আব্দুল লতিফ। ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নেওয়া শুরু করেছেন আব্দুল লতিফ। তবে শূন্য বেঞ্চগুলো পূর্ণ হয়ে স্কুলটি আবার কলরবে ভরে উঠবে, এমনটা আশা করতে পারছেন না তিনি। কারণ, এই স্কুলের অন্তত ৫০ ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে।

আব্দুল লতিফ জানেন, বিয়ে হওয়ার পর খুব কম শিক্ষার্থীই আবার পড়াশোনায় ফিরতে পারে।

স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও অধিকারকর্মীরা জানিয়েছেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় নানা অজুহাতে বাল্যবিবাহ দেওয়ার প্রবণতা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। করোনাকালে এ বছর স্কুলের ৬৬ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এদের মধ্যে ৫০ জনের হয়েছে বাল্যবিবাহ।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সদর উপজেলার ইউএনও এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির যতটা সক্রিয়ভাবে কাজ করার কথা ছিল, করোনার কারণে তারা ততটা করতে পারেনি। এক সপ্তাহের মধ্যে বৈঠক করে করণীয় ঠিক করা হবে।

করোনাকালে বাল্যবিবাহ বন্ধের লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে দেশ। ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সর্বশেষ জরিপ (মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯-এমআইসিএস) বলছে, দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকারের কর্মপরিকল্পনায় ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, এ হার ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু ২০২০-২১ সালে এই হার কতটুকু কমেছে বা বেড়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায়নি।

সাতক্ষীরার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, বাল্যবিবাহ হয়েছে এমন ৫০ জনের মধ্যে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রী রয়েছে ৩২ জন। দশম শ্রেণির ১৪ জন, নবম শ্রেণির ৭ জন এবং অষ্টম শ্রেণির ১১ জন রয়েছে। এ ছাড়া ১৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। স্কুলে থাকা তথ্য অনুসারে এই মেয়েদের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছর।

বিয়ে হওয়া বাকি ১৬ জনের ৩ জন দশম শ্রেণির এবং ১৩ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তাদের বয়স বাল্যবিবাহের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮ বছর পেরিয়েছে। স্কুলে মোট ছাত্রীসংখ্যা ৪৭০।

গত বছর (২০২০) স্কুলটিতে ৩২ ছাত্রীর বিয়ে হয় বলে জানান প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল লতিফ।

প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ জানান, এবার স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ৬৮ জন। এদের মধ্যে ৪৭ জন ফরম পূরণ করেছে, বাকি ২১ জন ফরম পূরণ করছে না কেন, খোঁজ করতে শিক্ষকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন, প্রত্যেকটি মেয়ের গোপনে বিয়ে হয়ে গেছে। দশম, নবম ও অষ্টম শ্রেণির মেয়েদের বাল্যবিবাহের তথ্য ধরা পড়ে তারা অ্যাসাইনমেন্ট জমা না দেওয়ায়। তিনি বলেন, পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়েছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, তারা আর পড়বে না।

প্রধান শিক্ষক আরও জানান, দুই মাস আগে তিনি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে ৪৭ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার তালিকা পাঠিয়েছিলেন। গত দুই মাসে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে।

তবে প্রধান শিক্ষকের ভাষ্য, যাদের বাল্যবিবাহ হয়েছে, তাদের কেউ কেউ স্কুল কোচিংয়ে যোগ দিয়েছে।

আলীপুর ইউনিয়নের সরকার ঘোষিত বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটির সদস্য আলীপুর পূর্ব পাড়া সুন্নি মসজিদের খতিব এবং স্থানীয় কাজি মো. রেজাউল করিম বলেন, বাল্যবিবাহ আইনসংগত না হওয়ায় নিবন্ধনও হয় না। নিবন্ধন ফরমের নকল বিধিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন দোকান বিক্রি করে। কিছু মাওলানা কাজি সেজে সেই সব নকল ফরমে বিয়ে পড়ান।

আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা জানান, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন দুই মাস আগে। বরের নিজের মোটর গ্যারেজ আছে। তিনি ছোটখাটো বেসরকারি চাকরি করেন। গরিব মানুষ, তাই ‘ভালো পাত্র’ হাতছাড়া করতে চাননি। মেয়ে আর পড়াশোনা করবে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘ওরা (মেয়ের শ্বশুরবাড়ি) আর পড়াতে চায় না।’

ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া আরেক ছাত্রীর বাবাও জানালেন, ‘ভালো পাত্র’ পাওয়ায় বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, বিয়েতে মেয়ের আপত্তি ছিল না। নিজ বাড়িতে বিয়ে হয়েছে। কেউ বাধা দেয়নি।

জেলার বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে গড়া বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির প্রশাসনিক প্রধান মো. সাকিবুর রহমান জানান, স্কুলটির ৫৭ ছাত্রীর বাল্যবিবাহের কথা তাঁরা জানতে পেরেছেন। দাদি-নানিদের ইচ্ছাপূরণ, মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক হওয়ার ভয়, বখাটেদের উৎপাত থেকে বাল্যবিবাহের ঘটনা বেশি ঘটে। দারিদ্র্যকে অজুহাত দেওয়া হলেও এ কারণে বিয়ে খুব বেশি হয় না। গত আট বছরে ১ হাজার ২০০ বিয়ে প্রতিরোধের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে একশর মতো পেয়েছিলেন, যাঁরা দারিদ্র্যের কারণে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে তিনি দেখেছেন, দুই-তৃতীয়াংশকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের কোনো নথিপত্র থাকে না বলে প্রয়োজন হলে কোনো মেয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে না।

সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন এতসংখ্যক বাল্যবিবাহের তথ্য জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। রোববার রাতে তিনি বলেন, খোঁজ নেওয়ার পর কথা বলবেন। পরে প্রথম আলোকে জানান, তিনি ২৫টি বাল্যবিবাহের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এই সংখ্যাও অনেক বেশি। ইউনিয়নের বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি কী করে, বুঝি না!’

জানা গেছে, পরিস্থিতি বুঝতে গতকাল সোমবার তিনি স্কুলটি পরিদর্শন করেছেন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

সাতক্ষীরা সদর ইউএনও ফাতেমা–তুজ–জোহরা বলেন, ‘আলীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমাকে জানিয়েছিলেন, ছেলে–মেয়েদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকায় বিয়ে হচ্ছে বেশি। তবে সংখ্যাটি এত বেশি কি না যাচাইয়ের প্রয়োজন আছে।’ তিনি জানান, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সদর উপজেলায় ৪৯টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে।

ইউএনও জানান, করোনার কারণে কিছু উদ্যোগ কম হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বৈঠক ডেকে করণীয় ঠিক করবেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)