কলারোয়ায় একই পরিবারের ৪ জনকে কুপিয়ে হত্যা যুক্তিতর্ক শেষ, ২৯ আগষ্ট রায়

রঘুনাথ খাঁ,সাতক্ষীরাঃ

সাতক্ষীরার কলারোয়ার হেলাতলা ইউনিয়নের
খলিসা গ্রামে একই পরিবারের স্বামী স্ত্রী ও তাদের দু’ সন্তানকে
নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আদালতে
রোববার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। সাতক্ষীরার জেলা ও দায়রা জজ
আদালতে আসামীপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের শুনানী শেষে আগামি ২৯ আগষ্ট মামলার
রায় এর জন্য দিন ধার্য করেছেন বিচারক শেখ মফিজুর রহমান।
এদিকে রোববার দুপুরে পৌন ১২টার দিকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে
রাষ্ট্রপক্ষের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফ বলেন, মামলার ১৮ জন সাক্ষীর
জবানবন্দি, রায়হানুলের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, জব্দ
তালিকা ও বাদির দায়েরকৃত এজাহার সাক্ষ্য প্রদানকালে হুবহু মিল থাকায়
আসামী রায়হানুলের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকা
নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের পরপর ই কলারোয়ায় এ ধরণের ফোর
মার্ডার সংগঠিত হয়েছে। আসামীপক্ষের আইনজীবী এ্যাড. এসএম
হায়দার আলী রায়হানুলের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বিচারক বিলাস কুমার
মণ্ডল আসামী স্বীকারোক্তি না দিলে তাকে আর পুলিশে না দিয়ে জেল
খানায় পাঠানো হবে না এমন কথা না বলায় সে বাধ্য হয়ে
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে আদালতে উপস্থাপন করলে
অ্যাড. আব্দুল লতিফ ২৫ ডিএলআর এর ৪১ অধ্যায় ও ২১ ডিএলআর এর ১২২
অধ্যায়ের ব্যাখ্যা দিয়ে তা খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। একইসাথে এ ধরণের
মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি
নির্দেশনা বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার সর্বোচ্চ শাস্তি
মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন তিনি।
তবে আসামীপক্ষের আইনজীবী অ্যাড. এসএম হায়দার আলী বলেন,
আসামীর সহিত তার ভাই ও ভাবীর কোন বিরোধ ছিল না। তবে জমি
নিয়ে প্রতিবেশী আকবরের সঙ্গে তাদের মামলা ছিল। অস্ত্রের মুখে
জিম্মি করে আকবর আলী তাদের জামিতে বাড়ির ভিত তৈরি করেছিল। এ
ঘটনায় মামলা ছাড়াও কয়েকটি সাধারণ ডায়েরীও আছে। এ ছাড়া
২০১৯ সালে শাহীনুরের বিরুদ্ধে কলারোয়া থানায় একটি মাদকের মামলা
আছে। মাদকের টাকার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে এ ধরণের হত্যাকাণ্ডও ঘটতে
পারে। মাছ চাষ করতে যেয়ে শাহীনুর ১১ লাখ টাকা ঋণী ছিল। বাড়ির উঠান সংলগ্ন পুকুরে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতি না ফেলে অনেক দূরে
দুর্গম জায়গার একটি পুকুরের মধ্যে তা ফেলে দেওয়ার বাস্তবতা নিয়ে
প্রশ্ন তোলেন ওই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। চাপাতি উদ্ধার ও জব্দ তালিকা
প্রস্তুতের সময় নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। তা ছাড়া কোন
চেতনানাশক ব্যবহার না করে কোকো কোলার মধ্যে বিশেষ ধরণের
ট্যাবলেট ব্যবহারের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। একই সাথে
নিহতের পরিবারের লোকজনদের বাদ দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে ১৫ কিলোমিটার
দূরে ওফাপুর গ্রামের শাহীনুরের শ্বাশুড়ি ময়না বেগমকে দিয়ে মামলা
করানোর ফলে আসামী ন্যয় বিচার না পাওয়ার একটি পরিকল্পনা বলে মনে
করেন তিনি। আসামীকে পাঁচ দিনের রিমাণ্ডে নিয়ে তিন দিন পুলিশ
হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক
জবানবন্দির জন্য তাকে কোর্টে পাঠিয়ে দিয়ে পরে সিআইডির
প্রেস ব্রিফিং দেওয়ার বিষয়টিও উঠে আছে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে।
এ ছাড়া মামলার কোন প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় একজনকে সাজা দেওয়ার
পক্ষে অনেক অন্তরায় থেকে যায় বলে তিনি জানান। সবশেষে তিনি
আসমী রায়হানুলের বেকসুর খালাস দাবি করেন।
ঘটনার বিবরনে জানা যায়, কলারোয়া উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের
খলিষা গ্রামের শাহজাহান ডাক্তারের বড় ছেলে শাহীনুর রহমান আট বিঘা
জমিতে পাঙ্গাস মাছ চাষ করেন। মেঝ ছেলে আশরাফ আলী মালয়েশিয়ায়
থাকেন। ছোট ছেলে রায়হানুর রহমান বেকার। বেকারত্বের কারণে বড় ভাই
শাহীনুরের সংসারে সে খাওয়া দাওয়া করতো। শারীরিক অসুস্থতার কারণে
কোন কাজ না করায় গত বছরের ১০ জানুয়ারি স্ত্রী তালাক দেয় রায়হানুর
রহমানকে। সংসারে টাকা দিতে না পারায় শাহীনুৃরের স্ত্রী দেবর
রায়হানুরকে মাঝে মাঝে গালমন্দ করতো। এরই জের ধরে গত ১৪ অক্টোবর
রাতে ভাই মোঃ শাহীনুর রহমান(৪০) ভাবী সাবিনা খাতুন(৩০), তাদের
ছেলে ব্রজবক্স সরকারি প্রাথমিক বিদ্যূালয়েরে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র
সিয়াম হোসেন মাহী(১০) ও মেয়ে একই বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর
ছাত্রী তাসমিন সুলতানাকে(৮) কোমল পানীয় এর সাথে ঘুমের বাড়ি
খাওয়ায় রায়হানুল। পরদিন ১৫ অক্টোবর ভোর চারটার দিকে হাত ও পা বেঁধে
তাদেরকে একে একে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
হত্যাকারী ওই পরিবারের ৪ মাসের শিশু মারিয়াকে হত্যা না করে লাশের পাশে
ফেলে রেখে যায়। এ ঘটনায় নিহত শাহীনুরের শ্বাশুড়ি কলারোয়া উপজেলার
উফাপুর গ্রামের রাশেদ গাজীর স্ত্রী ময়না খাতুন বাদি হয়ে কারো নাম
উলে-খ না করে থানায় ১৫ অক্টোবর একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।মামলার তদন্তে নেমে সিআইডির সাতক্ষীরা অফিসের পুলিশ পরিদর্শক
শফিকুল ইসলাম সন্দিগ্ধ আসামী হিসেবে শাহীনুরের ভাইর রায়হানুর
রহমান, একই গ্রামের রাজ্জাক দালাল, আব্দুল মালেক ও ধানঘরা গ্রামের
আসাদুল সরদারকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত রায়হানুরকে রিমাণ্ডে
নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ২১ অক্টোবর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম
বিলাস মণ্ডলের কাছে একাই হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায়
জবানবন্দি দেয়। একই দিনে সিআইডির খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি শেখ
ওমর ফারুক তার সাতক্ষীরা অফিসে এক সংবাদ সম্মেলন করে হত্যার মোটিভ
সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন। তদন্তভার গ্রহণের এক মাস আট দিন পর ২৮
হনের সাক্ষী ও রায়হানুলের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি পর্যালোচনা শেষে ২৪
নভেম্বর মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা রায়হানুলকে একমাত্র আসামী করে
৩২৮ ও ৩০২ ধারায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগ
প্রমাণিত না হওয়ায় আসাদুল, রাজ্জাক ও আব্দুল মালেককে মামলা থেকে
অব্যহতি পান। পরবর্তীতে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার ১৮ জন
সাক্ষী ও এক জন সাফাই সাক্ষী দেন। তবে পরবর্তীতে আসামীপক্ষের
আইনজীবী অ্যাড. ফরহাদ হোসেন রায়হানুলের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি
প্রত্যাহারের আবেদন জানালে আদালত তা নথিভুক্ত করে।
নিহত পরিবারে বেঁচে থাকা একমাত্র শিশু মারিয়া বর্তমানে হেলাতলা
ইউপি সদস্য নাছিমা খাতুনের কাছে বড় হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফ শাহীনুরসহ তার
পরিবারের চারজনকে নৃশংসভাবে হত্যা মামলায় রায় আগামি ২৯ আগষ্ট
বলে সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)