আসামীর স্বাক্ষরের নামে আইনজীবী সমিতির ৫ হাজার টাকা করে আদায়

রঘুনাথ খাঁঃ

গারদখানা থেকে ওকালতনামায় আসামীর সাক্ষর করানোর নামে পাঁচ হাজার টাকা আইনজীবী সমিতির ফাণ্ডে জমা নেওয়া হচ্ছে।

নিয়মবহির্ভুতভাবে এ টাকা আদায়
করার ঘটনায় বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা যায়, থানা ও গারদের এক শ্রেণীর অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কতিপয় আইনজীবী, আইনজীবী সহকারি ও আদালতপাড়ায় টাউট হিসেবে
পরিচিত কয়েকজন থানা থেকে আসামী আদালত গারদে আনার পরপরই কোর প্রকার কথাবার্তা ও টাকা ছাড়াই আসামীর কাছ থেকে ওকালতনামায় সাক্ষর করিয়ে নেওয়া হতো। পরে ওই আসামী বা
আসামীদেরকে জামিন করানোর নামে তার পরিবারের কাছ থেকে ইচ্ছামত টাকা আদায় করা হতো। এমনকি দাবিকৃত টাকা না দিতে পারলে আসামী ও তার পরিবারের দুর্গতির শেষ থাকতো না। এ হেন পরিস্থিতিতে জেলা আইনজীবী সমিতি কঠোর হয়েও বিচারপ্রার্থীদের এ হয়রানি বন্ধ করতে পারছিলো না। বাধ্য হয়ে গত বছরের মাঝামাঝি নাগাদ সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী
সমিতির সভাপতি অ্যাড. এম শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক তোজাম্মেল হোসেন তোজামের নেতৃত্বাধীন কমিটি গারদ খানা থেকে ওকালতনামায় আসামীর সাক্ষর গ্রহণ বন্ধ করে দেন।

সেক্ষেত্রে জেলখানা থেকে ওকালতনামায় সাক্ষর করাতে যেয়ে আদালতে পাঠানোর দিনেই ৩৪ ধারা, ননএফআইআর মামলা, জুয়াড়ী আইনের
৩ ও ৪ ধারার মামলার আসামীদের জামিন বা জরিমানা দিয়ে মুক্তির সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে পাঁচ হাজার টাকা আইনজীবী
সমিতির ফাণ্ডে জমা দিয়ে ওই মানি রিসিভ গারদখানায় জমা দিয়ে ওকালতনামায় আসামীর সাক্ষর করানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে
বিচারপ্রার্থীদের বিড়ম্বনা হলেও পকেট গরম হয় আইনজীবী সমিতির কর্মকর্তাদের। প্রতিবাদ করে বা প্রতিকার চেয়েও লাভ হয়নি বিচারপ্রার্থী ও তাদের মনোনীত আইনজীবী ও আাইনজীবী সহকারিদের। উপরন্তু একই মামলার একই আসামীদের
কাছ থেকে পৃথক আবেদনের মাধ্যমে দু’ বার টাকা নেওয়ার অভিযোগ হয়েছে। পাঁচ হাজার টাকা জমা নিয়ে গারদখানা থেকে আসামীর ওকালতনামায় সাক্ষর করানোর বিষয়টি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে কোন কোন আইনজীবী কোন
কোন বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন।

এরপরও বিষয়টি অব্যহত আছে। সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির কাছে জমাকৃত টাকার
রসিদ পর্যালোচনা করে জানা গেছে গত ১৮ জুলাই শ্যামনগর থানায় দায়েরকৃত র‌্যাব এর উপর হামলা মামলার(জিআর-২১৪/২১ শ্যাম) আসামী রমজাননগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আল মামুনকে
সোমবার দুপুরে আদালতে আনা হয়। ওই দিনই সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. আব্দুল মজিদ(২) জেলা আইনজীবী সমিতিতে পাঁচ হাজার টাকা জমা করে
তড়িঘড়ি করে গারদ থেকে ওকালতনামায় সাক্ষর করান। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিচারক রাকিব উল ইসলাম বাদির রিমাণ্ড না’মঞ্জুর করে
পুলিশ রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তাকে পাঁচ হাজার টাকা বণ্ডে জামিন দেন। একইভাবে পাটকেলঘাটা থানার ননজিআর ৩/২১ মামলার আসামী পুটিয়াখালির জিয়ারুলের পক্ষে অ্যাড. রোকনুজ্জামান মামুন গতকাল রোববার, আইনজীবী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সাঈদুর রহমান গত ৫ জুলাই সদর থানার জুয়া আইনের ৩ ও ৪ ধারার ১১ নং মামলায় পরদিন টাকা জমা দিয়ে মাছখোলার নিতাই সানাসহ পাঁচজনের জামিন শুনানী করেন। গত ৫ মে সদর থানার ৫১/২১ নং ননজিআর মামলায়
সুলতানপুরের আমিনুর রহমান সুমন ও ধুলিহরের মোছাঃ শারমিন এর ওকালতনামায় সাক্ষর করতে অ্যাড. শেখ ফারুক ও বরুন কুমার সানা
পৃথকভাবে পাঁচ হাজার করে আইনজীবী সমিতিতে জমা দিয়েছেন। শ্যামনগর থানার জিআর -২০৮/২১ নং মামলার আসামী উপজেলার ছোট কুপটের কাদের সরদারের পক্ষে অ্যাড. এম শাহ আলম,
কলারোয়া / ফৌজদারি ২৫৪/১৯ খুলনা মামলার আসামী যশোরের শার্শা থানাধীন টেংরা গ্রামের প্রান্ত মাহমুদ শেলীর পক্ষে গত ৯ মার্চ অ্যাড. এম শাহ আলম, পাটকেলঘাটা থানার ননজিআর ২৪/২১
নং মামলার আসামী সুজিত গোলদারসহ তিনজনের পক্ষে গত ১১ মার্চ অ্যাড.এসএম ফয়সাল, সিআর- ৬০০/২০ (শ্যামনগর) নং মামলায় আসামী পোড়াকাটলার অহিদুজ্জামানের পক্ষে
অহিদুজ্জামানের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে জমা নেওয়া হয়েছে। গত ৪ ফেব্র“য়ারি সাতক্ষীরা থানার ৯ নং মামলার আসামী পলাশপোলের নুরজাহানের পক্ষে অ্যাড. জাহিদ আল মাসুদ, গত ৩ ফেব্র“য়ারি সদর থানার ননজিআর ৬৩/২১ নং মামলার আসামী ইটাগাছার জজ মিয়ার পক্ষে অ্যাড. আব্দুল মজিদ, গত ২৮
ফেব্র“য়ারি সদরের খেজুরডাঙার দীন মোহাম্মদের পক্ষে সিসি
কেস ১৭১৮/৯৪-৯৫ মামলায় অ্যাড. শাহ আলম, সাতক্ষীরার জিআর-
৭১/১৯, টিআর-৯৬/১৯ মামলায় তলুইগাছার আব্দুল খালেকের পক্ষে
অ্যাড. আবু জাহিদ ও গত ২০ ফেব্র“য়ারি ননজিআর ১০৬/১৯ নং
মামলার আসামী রায়পুরের শাহাজউদ্দিনের পক্ষে আইনজীবী সহকারি
আবুল কাশেম পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন।
রোববার জামিনে মুক্তি পাওয়া পাটকেলঘাটার পুটিয়াখালির
জিয়ারুল ইসলাম বলেন, তিনি ঢাকার একটি গার্মেন্টস
ফ্যাক্টরীতে কাজ করেন। ১১ মাস পর শনিবার রাত ১০ টার দিকে বাড়ি
আসার পরপরই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ঈদে বাচ্চা ও স্ত্রীর জন্য
জামা কাপড় কেনার টাকা আইনজীবী সমিতিতে জমা দিতে হলো।
এটা কোন দেশে আইনসিদ্ধ কিনা তার জানা নেই। একইভাবে
রমজাননগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আল মামুন বলেন, একজন গরীব
বিচারপ্রার্থীর জন্য যথেষ্ট হয়রানিকর বলে তার মনে হয়েছে। একই
কথা বলেন সদর উপজেলার রায়পুরের শাহজুদ্দিন। তিনি বলেন এটা
মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম লঙ্ঘন। আগেও আইনজীবীদের হাতে
বিচারপ্রার্থীরা প্রতারিত হেেয়ছেন । বর্তমানে পাঁচ হাজার
টাকা সমিতিতে জমা দিয়ে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার
হচ্ছে। পোয়াবারো শুধু আইনজীবীদের। এ কালা কানুন বন্ধ হওয়া
উচিত।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফ বলেন,
আইনজীবী সমিতির এ হেন টাকা জমা নেওয়ার বিধান মেনে
নেওয়া যায় না। বর্তমান কমিটির উচিত বিষয়টি ভেবে দেখা।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাড.
বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. রেজোয়ান উল-াহ
সবুজ বলেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। সভাপতিকেই
জিজ্ঞাসা করুন।
সমিতির বর্তমান সভাপতি অ্যাড. আবুল হোসেন (২) বলেন,
অ্যাড. শাহ আলম ও অ্যাড. তোজাম্মেল হোসেন তোজামের সময়ে
ওই ধরনের টাকা জমা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । বিষয়টি
বিচারপ্রার্থীদের কাছে কষ্টকর উলে-খ করে তিনি বলেন, বিষয়টি
নিয়ে খুব শ্রীঘ্রই সভা ডেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তণ করার
প্রস্তাব রাখা হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)