২০শে মে চুকনগর গণহত্যা দিবস-ইতিহাসে একটি নৃশংসতম গণহত্যা
আব্দুর রশিদ বাচ্চু।।
২০ মে চুকনগর গণহত্যা দিবস। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই দিনে খুলনা জেলার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত চুকনগরে ঘটে যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি নৃশংসতম গণহত্যা। সে প্রেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের বেদনাদায়ক গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত স্থান হয়ে রয়েছে চুকনগর। চুকনগর খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার অন্তর্গত। এই উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নে চুকনগর অবস্থিত। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত চুকনগর একটি ছোট্ট ব্যবসাকেন্দ্রিক এলাকা তথা বাজার। বস্তুত ভদ্রা, কাজীবাছা, খড়িয়া, ঘ্যাংরাইল প্রভূতি নদী ও শাখা নদী পথে এবং কাঁচারাস্তায় দোকোপ, বটিয়াঘাটা, রামপাল, তেরখাদা ও ফকিরহাঠ থেকে খুলনা – ডুমুরিয়া হয়ে চুকনগর ছিল সে সময়কার বিবেচনায় ভারতমূখী সর্বাধিক নিরাপদ পথ।
অসংখ্য নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ও সংকীর্ণ কাঁচা মাটির ওই পথে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল সম্ভব ছিল না। ফলে লোকজন ওই পথ বেছে নেয়। অন্যদিকে এলাকাটি সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যস্ততা লেগেই থাকতো। এছাড়া এলাকাটি ছিল কর্মমুখর। চুকনগর খুলনা শহর থেকে ৩২ কি.মি. পশ্চিমে ভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৯৭১ সালের এ দিনটিতে চুকনগরে স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালায়। তারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করে। বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ চালানো হয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে খুব অল্প সময়ের মধ্যে জঘন্যতম যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি চুকনগর গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ২০ মে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে খুলনার ডুমুরিয়ার ছোট্ট শহর চুকনগরে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা সেদিন নির্মম ভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। অতর্কিত এ হামলা চালিয়ে মুক্তিকামী ১২ থেকে ১৫ হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে তারা। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারদের করা গণহত্যার একক বৃহত্তম ঘটনা চুকনগর গণহত্যা। সে দিন ছিল মঙ্গলবার।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চুকনগরের গণহত্যা এক কালো অধ্যায় রচনা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা যে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তারই এক নীরব সাক্ষী হয়ে আছে আজকের চুকনগর পাতো খোলা বিলের শহীদ স্মৃতি স্তম্ভটি।
ওই দিন যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ পুরুষ হলেও বহু নারী ও শিশুকেও হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। অনেক শিশু মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল, সে অবস্থায়ই চলে ঘাতকের কামান। ঘাতকের বুলেট মায়ের বুকে বিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন মা, কিন্তু অবুঝ শিশু তখনও মায়ের স্তন মুখের মধ্যে রেখে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। এমনই কতো ঘটনা যে সেদিন ঘটেছিল, তার সঠিক ধারণা পাওয়া আজ কঠিন।
এলাকার প্রবীণেরা জানান, পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশের খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের একটি জনগোষ্ঠী জীবন বাঁচানোর তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময় বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভারতে যাবার উদ্দেশে রওনা হন। ভারতে যাবার জন্যে তারা ট্রানজিট হিসেবে বেছে নেন ডুমুরিয়ার চুকনগরকে। ১৯ মে রাতে সবাই চুকনগরে এসে পৌঁছান। পরদিন সকালে সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ার বিভিন্ন সীমানন্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার জন্য চুকনগরে সমাবেত হন তারা। সেখানে সমবেত কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। হাজার হাজার মানুষ চুকনগরের পাতোখোলা বিল, কাঁচাবাজার চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, কালী মন্দিরসহ বিভিন্ন শশ্মানে আশ্রয় নেন।
সারা রাত নির্ঘুম রাত কাটে শরণার্থী হতে যাওয়া এসব মানুষের। সকালে বিশ্রাম সেরে ভাত রান্না শুরু করেন তারা। কেউ চিড়ে-মুড়ি ও অন্যান্য শুকনো খাবার দিয়ে শরীরে চলার শক্তি সঞ্চার করে নিচ্ছলেন।
কিন্তু ২০ মে সকাল ১০টার দিকে তিনটি ট্রাকে করে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা চুকনগর বাজারের ঝাউতলায় (তৎকালীন পাতখোলা) এসে থামে। তাদের সঙ্গে ছিল হালকা মেশিনগান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। সাদা পোশাকে মুখঢাকা লোকজনও আসে। দুপুর ৩টা পর্যন্ত তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে। হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় অনেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই ডুবে মারা যান। লাশের গন্ধে ভারি হয়ে যায় চুকনগর ও এর আশপাশের বাতাস। মাঠে, ক্ষেতে, খালে-বিলে পড়ে থাকে লাশ আর লাশ।
বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শেষে এসব স্থান থেকে লাশ নিয়ে নদীতে ফেলার কাজ শুরু করেন স্থানীয়রা।চুকনগরের ফসলি জমিগুলোয় আজও পাওয়া যায় সেদিনের শহীদদের হাড়গোড়, তাদের শরীরে থাকা বিভিন্ন অলঙ্কার। চুকনগরে সেদিন কতো লোক জমায়েত হয়েছিলেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। অনেকের ধারণা লক্ষাধিক। চুকনগর গণহত্যা ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারদের করা গণহত্যার একক বৃহত্তম ঘটনা। তিনি জানান, এ স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে।
এদিকে প্রতি বছর চুকনগর গণহত্যা দিবস উপলক্ষে বছর চুকনগর গণহত্যা’৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বধ্যভূমিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
এ দিকে আজ ২০ শে মে ২০২১ বেলা ১১ টায় ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি খুলনার উদ্যোগে ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় প্রত্যক্ষদর্শি, জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্হিত থেকে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
Please follow and like us: