কালিগঞ্জে দিনমজুরকে ভারতীয় নাগরিক বলে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানোর অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

প্রতিপক্ষ মাদক চোরাচালানীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আটককৃত মোটর সাইকেলসহ তিনজনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়ে নিরীহ এক দিনমজুরকে ভারতীয় নাগরিক বলে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে।

শুক্রবার রাতে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক জিয়ারত হোসেনের নেতৃত্বে উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের ডেমরাইল গ্রাম থেকে তাদেরকে আটক করা হয়।

ধলবাড়িয়া ইউপি’র ১নং ওয়ার্ডের সদস্য প্রশান্ত হালদার ওরফে বাবু জানান, তার এলাকার বাহাদুরপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ ও সিরাজুল ইসলাম, ডেমরাইলের কৌশিক চক্রবর্তী ও একই গ্রামের বিধান কয়ালসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালানি পণ্য অবৈধভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে।

তিন মাস আগে বিধান কয়াল স্বস্ত্রীক ১০০ বোতল ভারতীয় ফেন্সিডিল, মদ ও গাজাসহ গ্রেপ্তার হয়। বিধানের ভাইপো উজ্জ্বল কয়াল ২০০ বোতল ফেন্সিডিলসহ দু’ মাস আগে গ্রেপ্তার হয়। সম্প্রতি ভারতীয় মাছের ডিম চোরাই পথে আনার বিরোধিতা করার ওই পাচারকারি চক্রটির সঙ্গে তার বিরোধ চরমে ওঠে। একপর্যায়ে ওই পাচারকারি দলের সদস্যরা কিছুদিন আগে প্রকাশ্য দিবালোকে তার বাড়িতে ঢুকে তাকেসহ তার স্ত্রী ও ভাইপোকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে জখম করে চলে যায়।

এ ঘটনায় তিনি বাদি হয়ে ওই চক্রটির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। এরপর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য আসামীরা তাকে ও তার লোকজনদের বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি দিয়ে আসছিল। ধলবাড়িয়া ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা ওই চক্রটিকে মদত দিয়ে থাকে।

প্রশান্ত হালদার আরো জানান, গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি তার গ্রামের ধনঞ্জয় কয়ালের মুদি দোকানে মাল কিনতে আসেন। এ সময় লাইট বন্ধ করে দু’টি মোটর সাইকেলে পাঁচজনকে ডেমরাইল গ্রামের মধ্যে ঢুকতে দেখে দেবেন মন্ডল ও সুভাষ মন্ডলকে ডেকে নিয়ে তিনি গ্রামের ভিতর হাঁটতে থাকেন।

পথিমধ্যে দেবেন ও সুভাষ দাড়িয়ে গেলেও তিনি এগিয়ে যেয়ে মনোরঞ্জন মন্ডলের বাড়িতে যেয়ে ছেলে সরোজিতের সঙ্গে হাতকড়া পরানো অবস্থায় বারান্দায় বসে থাকতে দেখেন। তিনি তাদের অপরাধ জানতে চান। এসময় উপ-পরিদর্শক জিয়ারত হোসেন তাদেরকে তক্ষক সাপের ব্যবসায়ি, কখনো মাদক ব্যবসায়ি আবার কখনো জুয়াড়ী বলে দাবি করেন। একপর্যায়ে মনোরঞ্জনকে ছেড়ে দেন।

এরপর এক পুলিশ সদস্য তার মোটর সাইকেলে বসে রাস্তার আসার কথা বলেন। পথে দেবেন ও সুভাষের সঙ্গে দেখা হলে কোন কথা না বলতে দিয়েই তাদের হাতকড়া পরিয়ে সরোজিতের বাড়িতে নিয়ে যায়। এ সময় বেড়াতে এসে ঘরের মধ্যে অবস্থানকারি মনোরঞ্জন মন্ডলের বড় ছেলে স্বপন মন্ডলের ভায়রাভাই শ্যামনগর উপজেলার কাচড়াহাঁটি গ্রামের রাধাকান্ত মন্ডলের ছেলে কমলেশ মন্ডলকে (৪৯) বিভিন্ন প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তাকেও পাচারকারি বলে হাতকড়া পরান জিয়ারত হোসেন। একপর্যায়ে এক লাখ টাকার বিনিময়ে চারজনকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন জিয়ারত আলী।

পরে এক গ্রাম পুলিশের কাছে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। টাকা না পেয়ে দেবেন, সুভাষ, সরোজিৎ ও কমলেশসহ তার (প্রশান্ত) ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটিও থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরদিন শনিবার দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে দেবেনের পিসেমহাশয় নিখিল কয়ালের মাধ্যমে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে মোটর সাইকেলসহ দেবেন, সুভাষ ও সরোজিতকে ছেড়ে দেন জিয়ারত আলী।

শনিবার বিকেলে আদালত থেকে জেলে পাঠানোর সময় কমলেশ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, অভাবের তাড়নায় তিনি দু’ একবার ভারতে কাজ করতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জিয়ারত আলী টানা সাড়ে তিন বছর এ থানায় রয়েছেন। এর আগে তিনি আশাশুনি থানাসহ জেলার কয়েকটি থানায় ১০ বছরের বেশি সময় চাকুরি করেছেন। ফলে তিনি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেলোয়ার হুসেন এর কাছের লোক হয়ে গ্রেপ্তার বানিজ্যে হাত পাকিয়েছেন বলে অভিযোগ প্রশান্ত হালদারের।

শ্যামনগর উপজেলার কাচড়াহাটি গ্রামের হরিপদ মন্ডল জানান, ভাই কমলেশকে কালীগঞ্জ থানায় ধরে নিয়ে গেছে জানতে পেরে শনিবার সকাল ৯টার দিকে কমলেশ এর জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারেশকাম ও চারিত্রিক সনদসহ কাকাত ভাই জয়যাত্রা টেলিভিশনের সাংবাদিক অনাথ মন্ডল, উৎপল মন্ডল, কেনারাম মন্ডল ও গোপালসহ কয়েকজনকে নিয়ে কালীগঞ্জ থানায় যান।

দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখে বিকেল তিনটার দিকে জিয়ারত হোসেন তাদেরকে বাড়ি চলে যেতে বলেন। তারা জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমানের কাছে দিয়ে বাড়িতে ফেরেন। বিষয়টি তারা কালীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে অবহিত করে রাত ৮টার দিকে আবারো থানায় আসেন। রাত ৯টার দিকে কমলেশকে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে জিয়ারত আলী মামলা দুর্বল ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছে ১৫ হাজার টাকা চান।

তারা টাকা দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে চলে আসেন। পরে তারা জানতে পারেন যে ৪৯ বছরের কমলেশকে ৪০ বছর দেখিয়ে কোন প্রমাণ ছাড়া ভারতীয় নাগরিক বানিয়ে সহকারি উপ-পরিদর্শক জিল্লুর রহমানকে বাদি করিয়ে মামলা দিয়েছেন জিয়ারত আলী।

কালীগঞ্জের ধলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বলেন, ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনজনকে ছাড়া হলেও কমলেশকে ভারতীয় নাগরিক বানিয়ে মামলা দেওয়ার বিষয় তিনি শুনেছেন।

কালীগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক জিয়ারত আলী আটকৃতদের ছেড়ে দেওয়ার নামে কারো কাছ থেকে টাকা নেওয়া ও মামলা দুর্বল ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করার জন্য টাকা চাওয়ার কথা অস্বীকার করেই বলেন, সার্কেল সাহেবের কথামত তিনজনকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ভারতীয় নাগরিক হিসেবে কোন কাগজপত্র না থাকলেও মুখের কথা অনুযায়ি কমলেশকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। কমলেশ এর জাতীয় পরিচয়পত্র তার কাছে রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিদর্শক স্যার বলতে পারেন।

কালীগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক মোঃ মিজানুর রহমান জানান, ভারতীয় নাগরিক বলায় কমলেশকে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তবে আসামী চালান দেওয়ার পর কমলেশ এর মূল জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার পর সেটি উপ-পরিদর্শক জিয়ারত হোসেনকে দিয়েছেন। টাকা নিয়ে তিনজনকে ছেড়ে দেওয়া ও কমলেশ এর কাছে টাকা চাওয়ার বিষয়ে তার জানা নেই।

 

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)