প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বেশি মানুষ মারা যায় এক ভাইরাসে
সাতরঙ ডেস্ক :
মানব সভ্যতার পাশাপাশি বিকাশ ঘটেছে সংক্রমক ব্যাধিরও। বিভিন্ন সময় এসব রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে এক স্থান থেকে অন্যত্র। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি প্রাণীদের পোষ মানিয়ে একই ছাদের তলে বসবাসের কারণে দিনে দিনে ভাইরাসঘটিত রোগ বেড়েছে। এছাড়াও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে মহামারি পর্যায়ের রোগ-ব্যাধি বিভিন্ন রুটের মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে।
বর্তমানে সারাবিশ্বে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার সূত্রপাত ২০১৯ সালের শেষদিন। অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর, চীনের উহান শহরে দেখা দেয় এই ভাইরাস। এরপর একে একে পুরো পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ে, আক্রান্ত হতে থাকে একের পর এক মানুষ। যা হাতে গুনে নয় বরং হাজারেই হিসাব করা সহজ। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে শত শত মানুষ। ঠাণ্ডা-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, এরপর মৃত্যু। সবচেয়ে ভয়ানক এবং আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে- ছোঁয়াচে হওয়ার কারণে একজনের থেকে অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এই ভাইরাস এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে পুরো বিশ্বে।
এমনই এক মহামারির মুখোমুখি হয়েছিল বিশ্ব ১০০ বছর আগে। সময়টা ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল। একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশ। ভাইরাসটি স্প্যানিশ ফ্লু হিসেবেই পরিচিত। নাম স্প্যানিশ ফ্লু হলেও স্পেনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই ছিল না। তবে এর উৎপত্তি কোথা থেকে তাও এখন পর্যন্ত অজানা। তবে ধারণা করা হয়, ফ্রান্সের ব্রিটিশ সেনা ঘাঁটি, নয় তো যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন সেনাদের দেহে প্রথম ধরা পরে এ ভাইরাসটি। এরপর চীনা শ্রমিকদের মাধ্যমে ইউরোপে এটি ছড়িয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা ইতিহাসবিদদের।
সেসময় অভিযোগ উঠেছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো অপপ্রচার চালাতে পারে তাই স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারিতে সঠিক মৃতের সংখ্যা ও এর বিস্তৃতি নিয়ে সঠিক তথ্য দেয়নি কোনো দেশ। এছাড়াও এর নামকরণে করা হয় একেবারেই যোগসূত্রহীন স্পেনের নাম। ফলে এর উৎস এবং বিস্তৃতি নিয়ে জানা যায়নি কিছুই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেখানে পাঁচ বছরে ১ কোটি ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, সেখানে স্প্যানিশ ফ্লুতে মাত্র দুই বছরে মারা যায় ২ কোটি মানুষ। অন্য এক হিসাবে, প্রাণঘাতী এইডসে ২৪ বছরে যে পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছে এক স্প্যানিশ ফ্লুতেই ২৪ সপ্তাহেই মারা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি মানুষ। পৃথিবীর এমন কোনো অঞ্চল ছিল না যেখানে এই ফ্লু ছড়ায়নি। ব্রিটিশ উপনেবেশিক আমলে ভারতে এ মহামারিতে প্রাণ যায় প্রায় এক কোটি মানুষের।
দক্ষিণ সাগর থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত ৫০ কোটির মতো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। তাদের এক পঞ্চমাংশের মৃত্যু ঘটে, অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী বিলুপ্তির পথে চলে যায়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সৈনিকদের গাদাগাদি করে থাকা এবং যুদ্ধকালীন অপুষ্টি এই রোগের বিস্তার ও এতে প্রাণহানি বাড়িয়ে দেয়। মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি।
স্প্যানিশ ফ্লুর কারণ ছিল এইচ১এন১ ভাইরাস। স্প্যানিশ ফ্লু যখন মহামারিতে রূপ নেয়, তখন বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম সেই সংবাদ প্রচারে বাধা-নিষেধ আরোপ করলেও স্পেনের মিডিয়া ফলাও করে এই ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের কথা প্রচার করেছিল। তাই এই মহামারির নাম হয়ে যায় স্প্যানিশ ফ্লু, যদিও এর প্রভাব ছিল পুরো ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাজুড়েই।
স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম ধাক্কাটি আসে মে-জুন মাসে। লন্ডনের কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েলকাম ট্রাস্টের গবেষক মার্ক হনিগসবাউম ১৯১৮ সালে এই মহামারি নিয়ে ‘লিভিং উইথ এঞ্জা’ নামে একটি বই লিখেছেন। মার্ক হনিগসবাউম বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জার খবর প্রথম এসেছিল আমেরিকায় সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প থেকে। ওই ক্যাম্পটি ছিল কেন্টাকিতে।
যুক্তরাষ্ট্রে সেসময় হঠাৎ করেই কয়েক হাজার মানুষের অসুস্থতায় হতভম্ব হয়ে পড়ে প্রশাসন। তখন স্কুল, কলেজ, থিয়েটারসহ জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা হয়। এতে আবারো এর সংক্রমন বেড়ে যায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা ঠেকাতে সন্দেহভাজনদের পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে। কঠোর পদক্ষেপের পর দীর্ঘ ছয়মাস পর স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন। স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারি আর এর শিক্ষা কাজে লাগালে কোভিড-১৯সহ নানা মহামারি রুখে দেয়া সম্ভব। এমনটাই মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসকরা স্প্যানিশ ফ্লুকে ‘ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মেডিকেল হলোকাস্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে স্প্যানিশ ফ্লুর থেকে কোভিড-১৯ এর মৃত্যুর হার এখনো অনেক কম। বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্প্যানিশ ফ্লুর শিক্ষা আমাদের করোনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারত। ১০০ বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লুর সময় স্কুল কলেজ, থিয়েটারসহ সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এতেই অনেকটা ঠেকানো গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু। এমনকি তখনই মাস্কের ব্যবহার শুরু হয়।
স্প্যানিশ ফ্লু এমন সময় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। যখন সবে মাত্র বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। তখন যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ হওয়ায় মানুষের মধ্যে এটি খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন অল্প সংখ্যক মানুষ ছাড়া বেশিরভাগই ছিল দরিদ্র শহরাঞ্চলের। যাদের মধ্যে ছিল পুষ্টি ও স্যানিটেশনের অভাব। এতে করে তারা দ্রুত ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছে আর মারা গিয়েছে। তবে এখনকার বিশ্বের অবস্থা অনেক উন্নত। তবুও সচেতনতা আর সঠিক সময়ে শিক্ষার ব্যবহার না করায় এর ফলাফল নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত। ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপে এই ফ্লুর মহামারি ভাব কেটে যায়। তবে করোনার কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং তাণ্ডব বেড়েই চলেছে।