সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালি মন্দিরে পূজা দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
আশিকুজ্জামান লিমনঃ
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর যশোরেশ্বরী কালিমন্দিরে পূজা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি। মন্দিরের অভ্যন্তরে তাকে মন্ত্র পাঠ করান পুরোহিত দিলীপ কুমার মুখার্জি।
শ্যামনগরের ইশ^রীপরে যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পর্দাপন, পূজা দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন। গতকাল ২৭ মার্চ ২০২১ তারিখ শনিবারে ঢাকা থেকে ১টি হেলিকপ্টারে নরেন্দ্র মোদি ও ১ টি হেলিকপ্টারে খাদ্যমন্ত্রী ডা: আব্দুর রাজ্জাক এবং বাকি ২টি হেলিকপ্টারে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুরে পৌঁছান। সকাল ১০.০৫ মিনিটে নরেন্দ্র মোদির হেলিকপ্টারটি ঈশ্বরীপুর এ-সুহবান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ প্রাঙ্গন হ্যালিপ্যাডে অবতরণ করেন এবং পাশ্ববর্তী মাঠে আলাদা আলাদা হ্যালিপ্যাড বাকি ৩টি হেলিকপ্টার অবতরন করেন। পরে গাড়ী পথে বহর নিয়েযশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে পৌঁছান নরেন্দ্র মোদি।
নরেন্দ্র মোদি ১০.২০ মিনিটে যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে প্রবেশ করেন। তাকে স্বাগত জানিয়ে মন্দিরের সেবায়েত পরিবারের সদস্য জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় (জয়তি চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) তাকে ঐতিহ্যবাহী ঢাক-ঢোল এবং শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে বরণ করে নেন। পরে নরেন্দ মোদি মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং পূজা দেন। ঐ সময়ে নরেন্দ মোদি কালি মা”য়ের মাথায় হাতে তৈরি গঁশ রূপার এবং সোনার ধাতুপট্টাবৃত দ্বারা তৈরি একটি মুকুট পরিয়ে দেন। পরে কালি মা”য়ের পরনের শাড়ী, মালা, ওড়না সহ বিভিন্ন কসমেটিকস্ প্রদান করে পূজা পাঠ শুরু করেন। পূজা পাঠ করেন বংশিপুর গ্রামের কৃতি সন্তান পুরোহিত দিলীপ কুমার মুখার্জী। ১০.৫৯ মিনিটে নরেন্দ্র মোদি পুজা শেষে মন্দির প্রদক্ষিন করে উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল হক দোলনের সাথে পরিচিত লাভ করে মানুষের সাথে কুশল বিনিময় করেন।
অতিথি হিসাবে ছিলেন, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল, জেলা পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, সাতক্ষীরা ৪ আসনের সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার, শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল হক দোলন, শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ.ন.ম আবুজার গিফারী। কঠোর নিরাপর্ত্তার সাথে ৩৯ মিনিট সময় দিয়ে সার্বিক কার্যক্রম শেষে নরেন্দ্র মোদি গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
মন্দির সম্পর্কে তথ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের যশোরেশ্বরী কালী মন্দির বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত মন্দির। এ শক্তিপীঠটি সাতক্ষীরা জেলার, শ্যামনগর উপজেলার, ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নে অবস্তিত যশোরেশ্বরী কালী মন্দির। যশোরেশ্বরী নামের অর্থ “যশোরের দেবী”। হিন্দু ভক্তদের জন্য এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান। সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞের পর সতী মাতা দেহ ত্যাগ করলে, মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করলে বিষ্ণু দেব সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহখন্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় এবং এ সকল স্থানসমূহ শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়। ধারনা করা হয় যে, মন্দিরটি আনারি নামের এক ব্রাহ্মণ কর্তৃক নির্মিত হয়। তিনি এই যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠের ১০০টি দরজা নির্মাণ করেন। কিন্তু মন্দিরটি কখন নির্মিত হয় তা জানা যায়নি। পরবর্তীকালে লক্ষাণ সেন ও প্রতাপাদিত্য কর্তৃক তাদের রাজত্বকালে এটির সংস্কার করা হয়েছিল। কথায় আছে যে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি এখানকার জঙ্গল থেকে একটি আলৌকিক আলোর রেখা বের হয়ে মানুষের হাতের তালুর আকারের একটি পাথরখন্ডের উপর পড়তে দেখেন। পরবর্তীতে প্রতাপদিত্ত্য কালীর পূজা করতে আরম্ভ করেন এবং এই কালী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। যশোরেশ্বরী কালী দর্শনের নাম করে সেনাপতি মান সিংহ প্রতাপাদিত্যের দুর্গের নকশা নিয়ে যান। পরে আক্রমণ করে মোগলরা সেটি জয়লাভও করে। কালীর বিগ্রহের সঙ্গে প্রতাপাদিত্য এবং তার সেনাপতি ও পরামশর্দাতা শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে বন্দি করেন মান সিংহ। জমিদার বাড়ির মধ্যে অবস্থিত ছিল।
তৎকালিন জমিদার বাবু মায়ের নামে প্রায় ২০০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। মায়ের পুজায় সমবেত ভক্তগণ ফুল, ফল ও নানাধরনের মিষ্টি আনেন। মাতৃমূর্তির সামনে সুন্দর করে কাঁসার থালা ও মাটির পাত্রে থরে থরে নৈবেদ্য সাজানো হয়। শ্রীযশোরেশ্বরীর পুজো তন্ত্রমতেও হয়। প্রতিবছর মন্দিরে খুব ধুমধাম করে শ্যামাপুজো হয়ে থাকে। মা ভীষণ জাগ্রত। শ্যামাপুজোয় এই মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত পুজো দেন। মানত করেন। বড় করে মহাযজ্ঞ হয়ে থাকে। মাকে নানা অলংকারে সাজানো হয়। মন্দিরের সামনে তিনদিন মেলা বসে। ছাগল বলি হয়। মন্দিরের বারান্দায় হিন্দু ভক্তদের পাশাপাশি মুসলমান ভদ্রমহিলারা ও মাকে ভীষণ মান্যি করে। মানত করতে আসে। মানত পূরণ হলে এক জোয়া পায়রা মন্দিরের বারান্দা থেকে উড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। মূল মন্দির সংলগ্ন স্থানে নাটমন্দির নামে একটি বৃহ মঞ্চমন্ডপ নির্মাণ করা হয়েছিল যেখান হতে দেবীর মুখমন্ডল দেখা যায়। এটি লক্ষাণ সেন বা মহারাজা প্রতাপাদিত্য কর্তৃক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু কারা এটি নির্মাণ করেছিল তা জানা যায়নি। ১৯৭১ সালের পর এটি ভেঙে পড়ে। সেই সুদৃশ্য, লম্বা-চওড়া বিরাট নাটমন্দিরের আজ কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই।
এখন শুধুমাত্র স্থম্ভগুলি দেখা যায়। দু-একটা স্থম্ভ কয়েক’শ বছরের নীরব সাক্ষী হয়ে ইটের পাঁজর বের করে দাঁড়িয়ে আছে কোন রকমে। একদা মন্দিরের চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর ছিল। মূল মন্দিরটি বাদে আর সবকিছুই আজ কালের গর্ভে বিলীন। মন্দিরের নওবতখানা এখন ভগ্নস্তুপ। তবে এবার নতুন করে যশোরেশ্বরী কালী মন্দির নতুন রুপে সাজগোজ শুরু হয়েছে।