তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আসছে তিন মেগাপ্রকল্প
তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মতো আরো তিনটি মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এগুলো হলো- বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২, সাবমেরিন ক্যাবল-৩ ও নিরাপদ ইন্টারনেট।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সরকার যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এখন পর্যন্ত যা বাস্তবায়ন করেছে তা প্রশংসার দাবিদার। শুধু শহরেই নয়, বরং জেলা-উপজেলা সদর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে দেয়া হয়েছে এই সেবা। এর আরো প্রসারে মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
আসছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২
বর্তমান সরকারের মেয়াদেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। মূলত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১-এর ব্যাকআপ তৈরি করতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের জন্য আলাদা করে কোনো অরবিটাল স্লট কিনতে বা ভাড়া নিতে হবে না। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ যে স্লটে (অরবিটাল স্লট ১১৯.১ ডিগ্রি) উৎক্ষেপণ করা হয়েছে সেখানে দুটি স্যাটেলাইট প্রতিস্থাপন করা যাবে। ফলে স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের কাজটি প্রথমটির চেয়ে দ্রুত হতে পারে।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ২-এর জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) কাছে আরো চারটি স্লট চেয়ে আবেদন করে রেখেছে বাংলাদেশ। ৬৯, ৭৪ ও ১০২ ডিগ্রি পূর্বতে দুটিসহ চারটির জন্য আইটিইউর কাছে আবেদন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএসসিএল) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ জানান, আমরা দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এই স্যাটেলাইট হবে হাইব্রিড স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইটটিকে যোগাযোগ, আবহাওয়া, নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আসাছে সাবমেরিন ক্যাবল-৩
দ্রুতগতির ব্যান্ডউইথ সেবা নিশ্চিত করতে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে দেশে যুক্ত হতে পারে। এরই মধ্যে সরকার সাবমেরিন ক্যাবল বিষয়ক কনসোর্টিয়ামে যুক্ত হতে সম্মতি জানিয়েছে। এখন থেকে ২-৩ বছরের মধ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল থেকে ব্যান্ডউইথ পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে ৯৫০ জিবিপিএস (গিগাবাইট পার সেকেন্ড) ব্যান্ডউইথ সেবা পাচ্ছে এবং ক্রমেই এটি বাড়ানো হচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ যখন প্রথম ও দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত তখন আর পেছনে ফিরে দেখার সময় নেই। তাই অচিরেই দ্রুতগতির নেট সুবিধা নিশ্চিত করতে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, ২০২১ সাল নাগাদ নতুন সাবমেরিনে যুক্ত হতে পারে বাংলাদেশ। নিজেদের তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের জন্য নতুন সি-মি-উই ৬ কনসোর্টিয়ামে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এরইমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে এ কনসোর্টিয়ামের উদ্যোক্তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশ এই ক্যাবলে থাকছে। সি-মি-উই (SEA-ME-WE) হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম ইউরোপের সংক্ষিপ্ত নাম।
এই এলাকার মধ্য দিয়ে ক্যাবলটি স্থাপিত বলে প্রতিটি ক্যাবলের নামে এমনটা যুক্ত থাকে। যেমন সি-মি-উই ৪, সি-মি-উই ৫। সর্বশেষ সি-মি-উই ৫ কনসোর্টিয়ামে এই এলাকার দেশগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জিবুতি, মিসর, তুরস্ক, ইতালি, ফ্রান্স, মিয়ানমার, ইয়েমেন।
এই ১৯ দেশ ১৯টি ল্যান্ডিং পয়েন্টের মাধ্যমে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নতুন সি-মি-উই ৬ কনসোর্টিয়ামেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম ইউরোপ থেকেই দেশগুলো যুক্ত হবে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, সি-মি-উই ৬ এ যোগ দেয়ার বিষয়টি এরইমধ্যে অফিসিয়ালভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অতীতের ৫টি কনসোর্টিয়ামই সফলভাবে চালু করা হয়েছে। ক্যাবল লাইন কেবলমাত্র হওয়া না, ক্যাবল লাইন সিগনেফিকেন্টটি-টেকনোলজিক্যালি সাউন্ড হয় সেটাই ফ্যাক্টর। এই সি-মি-উই রুটে এখন যে কোনো কনসোর্টিয়াম সাকসেসফুল হবে।
তিনি জানান, ইন্ডিভিজ্যুয়াল লাইন করতে গেলে বা দু-একজনকে নিয়ে একটা কানেক্টিভিটি করতে গেলে সেটি ব্যয়বহুল হয়ে যায়। এ ব্যয়বহুল জায়গা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কনসোর্টিয়ামকে প্রেফার করা হয়েছে। যেভাবে আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করেছি তাতে কিছুদিন পরে আমাদের ব্যান্ডউইথের চাহিদা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকবে যে, সি-মি-উই ৫ দিয়ে তা আর সামাল দেয়া যাবে না।
আসছে নিরাপদ ইন্টারনেট
সবার জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করতে কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। পাশাপাশি শিশুরা যেন ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকে সে কারণেও কনটেন্ট ফিল্টারিং, পর্ন সাইট বন্ধের কাজে হাত দিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে মোস্তাফা জব্বার জানান, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ডিওটি বা ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকম একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরইমধ্যে প্রকল্পটির কাজ প্রায় শেষের দিকে। তখন ইন্টারনেটকে নিরাপদ রাখতে আরো বেশি সক্ষমতা অর্জন করবে দেশ।
দেশজুড়ে আগামী এক বছরের মধ্যে ১০ লাখ স্কুলশিশু নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারসংক্রান্ত সনদ পাবে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারসংক্রান্ত সনদ শিশুদের অনলাইন অভিজ্ঞতাকেই নিরাপদ করার পাশাপাশি দেশে অনন্য বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করবে। শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেটের ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে ইউনিসেফের সহায়তায় সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এই কার্যক্রম শুরু করবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, এক বছর সময়ের মধ্যে আমরা ১০ লাখ স্কুলগামী শিশুকে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের সনদ প্রদানের মাধ্যমে ইতিহাস তৈরি করব এবং অনলাইন ঝুঁকির বিরুদ্ধে আমাদের শিশুদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি তোমো হোজুমি বলেন, সাইবার প্রযুক্তির ঝুঁকি ও সম্ভাবনাগুলো বিবেচনা করার এবং ঝুঁকিগুলো কমিয়ে আনতে আমাদের সম্মিলিত প্রজ্ঞা ও শক্তি ব্যবহারের সময় এসেছে। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। কারণ এটি একই সঙ্গে বিশাল জ্ঞান ও তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে। যা আজকের এই বিশ্বে শিশুদের জন্য প্রয়োজন।