কালেরগর্ভে হারিয়ে যাওয়া “তিয়র রাজার” জীবন কাহিনী

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ধানদিয়া ইউনিয়নের মানিকহার গ্রামে আমার জম্ম।
গ্রামটি তালা ও কলারোয়া উপজেলার একেবারেই সীমান্ত ঘেষা। এই গ্রামে আমার
বেড়ে ওঠা। শৈশব, কৈশোর কেটেছে এই গ্রামেই।

যখন একটু বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই শুনতাম “মানিকহার” গ্রামটি
ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি গ্রাম। একসময় এখানে তিয়র রাজার বাসবাস ছিল। এই
রাজার ভিটেতে অনেক স্বর্ণ পুঁতে রাখা। মাটি খুঁড়লেই না-কি স্বর্ণ মেলে।
মনি-মুক্তার হার পাওয়া যায়। সেই ‘মনি-মুক্তার হার’ থেকেই গ্রামটির নামকরণ
“মানিকহার”। আবার কেউ বলেন গ্রামটির অতিত নাম “মণিঘর”। কালেরআবর্তে
গ্রামটির নাম হয়েছে “মানিকহার”।

স্কুলে যখন পড়তাম তখন প্রায় বাবার সঙ্গে তিয়র রাজার দিঘীর পাড়ে যেতাম।
বিশাল দিঘী। কাকের চোখের মত জল। দেখলে গা চমকে উঠতো। তিয়র রাজার দিঘী
নিয়ে অনেক কল্প কাহিনী শুনেছি। এই এলাকায় বড় ধরনের কোন বিয়ে-সাদি হলে
আগের দিন সন্ধ্যায় জানান দিয়ে আসলে না-কি দিঘীর কিনারায় গাদিগাদি কাশার
থালা, গ্লাস,চামচ রেখে যেতো। বিয়ের পরে সন্ধ্যায় আবার দিঘীর পাড়ে সেগুলো
রেখে আসলে না-কি সেগুলো অদৃশ্য হয়ে যেত।

২০ বছর আগেও তিয়র রাজার উচু ভিটেবাড়িতে গিয়ে সেই আমলের ইট, খোয়া, শুরকি
দেখেছি। দেখেছি বিশাল বিশাল একাধিক বট গাছ। কিন্তু এখন আর এসব দৃশ্যমান
নয়। অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। ভিটেবাড়ি আগের মত আর উচু নেই। এখন সমতলভূমি।
ভিটেতে ফলে ফসল। তিয়র রাজার সেই জমিদারি আজ ব্যক্তিমালিকানায় দখল।
স্থানীয় প্রশাসন নজরদিলে হয়তো উদ্ধার হতে পারে তিয়র রাজার সেই
জমিদারিত্ব, ইতিহাস,ঐতিহ্য।

কিন্তু গ্রামটির নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানবার আগ্রহটা আমার সেই ছোটবেলা
থেকেই। অনেক বই-পুস্তক ঘেটেছি। কিন্তু বিস্তর নামকরণের কোন ইতিহাস আমার
চোখে পড়েনি।

কৈশোরে বাবা-দাদাদের মুখে শুনতার রেডিও’তে তিয়র রাজার নাটক সম্প্রচার হয়
প্রতিবছর। বছরে না-কি একদিন। নিজ কানে শুনেছি। কিন্তু বহুদিন ধরে সেটাও
আর হয়না। কি কারণে সেই তিয়র রাজার নাটক এখন আর হয়না তা আমার জানা নেই।

আজ দুপুরে ইন্টারনেট ঘাটতে গিয়ে চোখে পড়লো টিয়র রাজার সেই জীবন কাহিনী।
এটাই সঠিক ইতহাস কি-না তাও জানিনা।

তবে পাঠকদের সামনে হুবহু সেটি তুলে ধরা হল :
—————————————————-
সাতক্ষীরা হইতে ১২ মাইল উত্তরে কলারোয়া থানার নিকটস্থ নওপাড়া-মণিঘর
গ্রাম ; ইহা গড়দানি নামেও অভিহিত। একটি মাটির গড়ের ভগ্নাবশেষ ও কতকগুলি
পুরাতন পুষ্করিণী এখানে দৃষ্ট হয়; এগুলি তিয়র রাজার কীৰ্ত্তি বলিয়া
কথিত।

কিংবদন্তী, কোনও এক সময়ে জনৈক তিয়র জাতীয় ব্যক্তি যখন বিলে নৌকা
করিয়া মাছ ধরিতে ছিলেন, তখন একজন সন্ন্যাসী তাহাকে বিলটি পার করিয়া
দিতে বলেন । তিয়র সম্মত হইয়া সন্ন্যাসীকে লইয়া যখন বিলটি পার
হইতেছিলেন, তখন দেখিলেন সন্ন্যাসীর ঝোলার স্পৰ্শণ পাইয় তাহার নৌকার একটি
লৌহ পাট সোণায় পরিণত হইল।

তিয়র বুঝিলেন ঝোলার মধ্যে পরশ পাথর আছে এবং লোভে পড়িয়া পাথরটি কড়িয়া
লইয়া সন্ন্যাসীকে গভীর জলে ফেলিয়া দিলেন ; জলে ডুবিবার সময়ে সন্ন্যাসী
অভিসম্পাত করিলেন যে তিয়র সপরিবারে বিনষ্ট হইবেন । পরশ পাথরের গুণে
তিয়রের বহু ধনদৌলত হইল এবং তিনি রাজা বলিয়া পরিচিত হইলেন। তিনি একটি
তুর্গ নিৰ্ম্মাণ করাইয়াছিলেন এবং ১২৬টি পুষ্করিণী খনন করাইয়া ছিলেন।

অল্পকাল মধ্যেই বাংলার নবাব তাহার ধনসম্পত্তি প্রাপ্তির কথা শুনিয়া
তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন । তিয়র ভাবিলেন হয়তো এরূপভাবে ধনপ্রাপ্তির
জন্য নবাবের হাতে প্রাণ হারাইতে হইতে পারে এবং পাছে মহিলাদের সন্ত্রম
হানি হয় এই জন্য সঙ্গে করিয়া একজোড়া বাৰ্ত্তাবাহী কপোত (পায়রা) লইয়া
গেলেন, বলিয়া গেলেন যে তাহার অবস্থা শোচনীয় জানিলে এবং মৃত্যু নিশ্চিত
বুঝিলে পায়রা দুইটি ছাড়িয়া দিবেন।

তিয়র রাজাকে নবাব সসম্মানে ছাড়িয়া দিলেন। অশ্বপৃষ্ঠে তিনি যখন গৃহে
প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, পায়রা দুটি হঠাৎ ছাড়া পাইয়া যায়।

ঘরে পায়রা ফিরিতে দেখিয়া তিয়র রাজার স্ত্রী ও সন্তানগণ একটি নৌকায়
করিয়া বড় পুকুরের মধ্যস্থলে পৌঁছিয়া নৌকার তলদেশে ছিদ্র করিয়া
ডুবিয়া প্রাণত্যাগ করেন। তিয়র রাজা প্রাণপণ শক্তিতে ঘোড়া ছুটাইয়া ঘরে
ফিরিয়া দেখিলেন সব শেষ হইয়া গিয়াছে, তখন তিনিও বড় পুকুরে ডুবিয়া
প্রাণত্যাগ করিলেন ; এইরূপে সন্ন্যাসীর অভিশাপ পূর্ণ হইল।

এই বড় পুকুরটিকে লোকে এখনও দেখাইয়া থাকে। গ্রামের যে স্থানে গড়ের
ভগ্নাবশেষ পড়িয়া রহিয়াছে উহাকে দানা-মণিঘর বা ‘ধনপোতার দান বলা হয় ;
লোকের বিশ্বাস উহার নীচে তিয়র রাজার ধনদৌলত প্রোথিত আছে।
( সূত্র :উইকিসংকলন )

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)