নভেল করোনা : মংলা বন্দরে কর্মহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শ্রমিক

মরণঘাতি নভেলা করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বে মন্দাভাব দেখা দেয়ায় মংলা বন্দরে জাহাজ আগমন নির্গমের সংখ্যা কমে গেছে। যার প্রেক্ষিতে এখানকার জাহাজ ও জেটিতে পণ্য ওঠানামার সাথে জড়িত কয়েক হাজার শ্রমিক কর্মচারী প্রায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে ।

‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে কাজ করা এসব শ্রমিক কর্মচারীরা কাজের অভাবে এখন পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করলেও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এদেরকে কোন সহায়তা দেয়নি বলে অভিযোগ। অপরদিকে কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার প্রাথমিক কোন উপকরনও দেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা থেকে কিছু সহযোগীতা শ্রমিক কর্মচারীরা পেলেও তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

মংলা বন্দরের হারবার ও ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাসের আগে এখানে কর্মরত প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক কর্মচারী ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে জাহাজ ও জেটিতে পণ্য বোঝাই খালাস কাজ করে মোটামুটিভাবে ভালই সংসার চালিয়ে আসছিলেন। সে সময় মোংলা বন্দরে প্রতিদিন গড়ে ১৫/১৬টি জাহাজের অবস্থান থাকতো। সেই সাথে বন্দর জেটিতেও কিছু পণ্য ওঠানামা করতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে করোনার কারণে এ বন্দরে এখন গড়ে প্রতিদিন ১০/১১টি জাহাজের অবস্থান থাকছে। পাশাপাশি কমে গেছে বন্দর জেটির অভ্যন্তরের অনেক কাজ।

মংলা বন্দর শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক একেএম সাহাব উদ্দিন বাগেরহাট২৪কে জানান, জাহাজ আগমনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে কাজ করা এসব শ্রমিক কর্মচারীর কাজ অর্ধেকের নীচে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় অনেকটা কর্মহীন থাকায় শ্রমিক কর্মচারীরা পরিবার পরিজন নিয়ে কোনমতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

মংলা উপজেলা প্রশাসন, পৌর কর্তৃপক্ষ, কোষ্ট গার্ড, নৌ বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু ত্রাণ ও সহযোগীতা শ্রমিকদের দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, আইন অনুযায়ী জাহাজ ও জেটিতে পণ্য ওঠানামায় জড়িত শ্রমিক কর্মচারীদের মুল মালিক  মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ।

অথচ বন্দর কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সু কৌশলে শ্রমিকদের মালিকানা ষ্টিভিডোরসের (ঠিকাদার) উপর চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে চাচ্ছেন। তিনি জানান, শ্রমিকদের উন্নয়ন বাবদ বিভিন্ন খাত থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ শ্রম কল্যাণ তহবিলে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও করোনা প্রাদুর্ভাবের এ দুর্যোগকালীন সময়ে বন্দরের ক্যাজুয়াল এসব শ্রমিক কর্মচারীদের কোন সহায়তায় এগিয়ে আসেনি।

এ ছাড়া যেসব শ্রমিক বর্তমানে জাহাজ ও জেটিতে কাজ করছেন তাদেরকেও কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রাথমিক উপকরন দেয়নি। প্রায় কর্মহীন হয়ে থাকা এসব শ্রমিক কর্মচারীরা বিকল্প কোন কাজ না জানায় অন্য কোথায় গিয়েও কাজ করতে পারছে না। ফলে শ্রমিকরা এক প্রকার করোনার ঝুঁকি নিয়েই জাহাজে কাজ করছে। অথচ শ্রমিকরাই বন্দর পরিচালনার মুল চাবিকাঠি।

রোববার, ৫ এপ্রিল সকালে  মংলা শহরের কয়েকটি শ্রমিক আবাসিক এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের সাথে কথা বললে তারা জানান, বর্তমান সময়ে তারা খুবই কষ্টের মধ্যে রয়েছেন। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যে সহায়তা ও ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এ অবস্থায় আরো কতদিন চলতে হবে তা নিয়ে দুঃচিন্তাগ্রস্ত। এ ছাড়া প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারী থাকায় অনেকে বিকল্পও কাজও করতে পারছে না। অপরদিকে স্বাস্থ্য সু রক্ষার কর্মক্ষেত্রে প্রাথমিক উপকরণ মাস্ক, হ্যান্ড গ্লোলভস, হ্যান্ড ওয়াশ, সাবানসহ আনুসাঙ্গিক অনেক সরঞ্জাম তারা বন্দর কর্তৃপক্ষ বা ষ্টিভিডোরসের কাছ থেকে পাচ্ছেন না।

শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা জানান, ইতিমধ্যে তাদের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। ত্রাণ ও সহায়তা যা পেয়েছেন তা দিয়ে সামান্য বিছুদিন কোন মতে চললেও বাকী দিনগুলোতে কিভাবে সংসার চালাবেন, ঘর ভাড়া প্রদাণ করবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। অনেক পরিবারই এখন তিন বেলা ঠিকমতো খেতে পারছেন না।

মংলা বন্দর ব্যবহারকারী ও ষ্টিভিডোরস কোম্পানী মেসার্স নূরু এন্ড সন্সের মালিক আলহাজ্ব এইচ এম দুলাল করোনা প্রভাবের কারণে শ্রমিক কর্মচারীদের কাজ কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এ অবস্থায় শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ ছাড়া শ্রমিকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও কাজ কমে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। অফিস ষ্টাফদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে। তিনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে কর্মহীন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষদের যে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেন।

এ বন্দর ব্যবহারকারী অন্যান্য ষ্টিভিডোরস মালিক ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের কাছে সংকটকালীন এ সময়ে কর্মহীন শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতি আরো বেশী সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবার আহ্বান জানান।

মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শেখ মোঃ আবুল কালাম আজাদ শ্রমিকদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শ্রমিকদের মালিক বন্দর কর্তৃপক্ষ নয়, তারা ষ্টিভিডোরসদের (ঠিকাদার) অধীনে কাজ করে। ঠিকাদারই তাদের দেখভাল করে থাকে। কাজকালীন সময়ে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার প্রাথমিক উপকরন প্রদানের বিষয়ে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। করোনা দুর্যোগে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রধান মন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ৫ কোটি টাকা অনুদান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেতে শ্রমিকদের কোন সহায়তা করা যায় কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)