যেমন ছিল বিশ্বের প্রথম অ্যাম্বুলেন্স
অসুস্থ রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বাহনটি সারা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত সেটি হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা কবলিতদের উদ্ধারের জন্য সতর্ক সংকেত দিতে দিতে দ্রুত হাজির হয় অ্যাম্বুলেন্স।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সহজতর হয়েছে। যদিও একটা সময় এমনটা ছিল না। অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় অনেক রোগী হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যেতো। আজকে আমরা যে অ্যাম্বুলেন্স দেখি প্রথম দিকে অ্যাম্বুলেন্স এমন ছিল না। কালের বিবর্তনে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্স (Ambulance)শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ambulare থেকে এসেছে। যার শাব্দিক অর্থ হাঁটা বা সামনে আগানো। সেই প্রাচীন আমলে অ্যাম্বুলেন্সের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়।
ইতিহাস অনুযায়ী ৯০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রথম অ্যাম্বুলেন্সের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে চট বা দড়ির চাদর দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের বিছানা নির্মিত হয়েছিল। এরপর এই চাদরকে দুই চাকার ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত করে দ্রুত গতির অ্যাম্বুলেন্স তৈরির চেষ্টা করা হয়।
প্রথম এই অ্যাম্বুলেন্স তৈরির কারিগর ছিলেন এঙ্গলো স্যাকসন। ১১ শতাব্দীর ক্রুসেডের সময়ে আহত সৈনিকদের ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে তৈরি অ্যাম্বুলেন্সে করে চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়া হতো।
১৪৮৭ সালে স্পেনে রানী ইসাবেলার শাসনামলে অ্যাম্বুলেন্সকে জরুরি কোনো কাজে লাগানো শুরু হয়। এই সময়ে কোনো যুদ্ধে স্পেন বাহিনীর সৈনিকরা আক্রান্ত হলে তাদের যুদ্ধ বিরতির আগ পর্যন্ত হাসপাতালে নেয়া হতো না। আহত সৈনিকদের অ্যাম্বুলেন্সেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হতো।
এরপরই অ্যাম্বুলেন্সের আকার আকৃতির প্রথম বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। আর পরিবর্তনটি সম্পাদন করেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের চিকিৎসক জেন ল্যারি। তার সময়ে অ্যাম্বুলেন্সে দুই চাকার বদলে চার চাকা ব্যবহার শুরু হয়। বোনাপার্টের যুদ্ধের সময় জেন ল্যারি তাদের সঙ্গে থাকতেন, যখন কোনো সৈনিক আহত হতো তখন তাকে মাঠে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হতো এবং পরে একাধিক সৈনিককে একসঙ্গে চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়া হতো।
১৮৩২ সালে লন্ডনে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়ার জন্য প্রথম সেখানে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবহার শুরু হয়। ১৮৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধ চলাকালে জোসেফ বার্নেস ও জনাথান লেটারম্যান অ্যাম্বুলেন্সের উন্নতির জন্য আরো কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোগ করেন। তারা অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য বিশেষ নতুন কিছু যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করেন। তাদের তৈরি দুই চাকা বা চার চাকার গাড়িতে একসঙ্গে দুই থেকে তিনজন রোগী বহন করা যেতো।
১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহেওতে বাণিজ্যিকভাবে হাসপাতালকেন্দ্রিক অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। ১৮৬৭ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডন মেট্রোপলিটন বোর্ড ৬ ঘোড়া বিশিষ্ট অ্যাম্বুলেন্সের প্রচলন করে। এই বাহনে রোগীদের আরামে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয় এবং এই বাহন ছিল দ্রুত গতির। নতুন এই ব্যবস্থা দেখাদেখি ১৮৮৯ সালে নিউইয়র্কের বেললোভি হাসপাতালে চার চাকার ঘোড়ার গাড়ির অ্যাম্বুলেন্স বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
১৯১০ সালে আয়ারল্যান্ডে রয়্যাল ডাবলিন সোসাইটির পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম জনগণের জন্য অ্যাম্বুলেন্স সেবার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯ শতকের দিকে ইঞ্জিনচালিত গাড়ির প্রচলন বৃদ্ধি পেলে চার চাকার গাড়িকে অ্যাম্বুলেন্স বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
রোগীদের আরো দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য ১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিকাগোর মাইকেল রিসি হাসপাতাল প্রথম অটোমোবাইল অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় করে। এই অ্যাম্বুলেন্সটি ক্রয় করতে হাসপাতালকে আর্থিক অনুদান দিয়েছিল শিকাগোর ৫০০ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী।
প্রথম ইঞ্জিনচালিত অ্যাম্বুলেন্স চলতো বিদ্যুৎ শক্তিতে এবং গাড়িগুলোর শক্তি ছিল দুই হর্স পাওয়ার। গ্যাসোলিন দ্বারা চালিত অ্যাম্বুলেন্সের প্রচলন হয় সর্বপ্রথম কানাডায় ১৯০৫ সালে। ১৯০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানিনগাম কর্তৃক একটি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু হয়। সে সময় তাদের ইঞ্জিনচালিত গাড়িটির গতি ছিল ৩২ হর্স পাওয়ার। মূলত এই সময়ের পর থেকে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের দ্রুত আধুনিকায়ন ও বিকাশ ঘটতে থাকে।
প্রত্যেক দেশে দেশে অ্যাম্বুলেন্সের প্রচার ও প্রচলন বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশে অ্যাম্বুলেন্সের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। ১৯১৪ সালের ১ম বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৪১ সালের ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাম্বুলেন্সের চাহিদা আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে এই সময়গুলোতে অ্যাম্বুলেন্সের উত্তরোত্তর আরো উন্নয়ন সাধিত হতে থাকে।
১৯২৮ সালে অস্ট্রেলিয়া অ্যাম্বুলেন্স সেবায় নতুন যুগের সূচনা করে। ঘোড়ার গাড়ি ও ইঞ্জিনচালিত অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের পর রোগীকে আরো দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বা বিমান অ্যাম্বুলেন্সের সূচনা করে। এই সার্ভিসের চিন্তা প্রথম এসেছিল অস্ট্রেলিয়ার এক মেডিকেল ছাত্র ক্লিফফোর্ড পিল এর মাথায়।
আধুনিকায়নের যুগে এসে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের আরো ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে দ্রুততর অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস রয়েছে। সরকারি, বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিগতসহ বিভিন্ন ধরনের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস এখন দেখা যায়। আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার নানা ধরনের উপকরণ ও যন্ত্রপাতি। অ্যাম্বুলেন্সকে বিপদের সময় দ্রুত কাছে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সরকারিভাবে হটলাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের নিরাপদে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক দেশের সামরিক বাহিনীতে সংযুক্ত করা হয়েছে বুলেট প্রুফ, বোমা প্রুফ ও শক্তিশালী অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। যুদ্ধক্ষেত্রের অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে রোগীকে দ্রুত পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা প্রদানের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অ্যাম্বুলেন্স সংযুক্ত সামুদ্রিক জাহাজ হাসপাতাল রয়েছে। যুদ্ধের সময় আহত সৈনিকদের এই জাহাজে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও আধুনিক হয়েছে। ফলে সমাজের উচ্চশ্রেণী থেকে শুরু করে নিম্নশ্রেণীর সবাই অ্যাম্বুলেন্স সেবা গ্রহণ করে থাকে। আর তাই অ্যাম্বুলেন্স এখন বিপদের বন্ধু।