বাগেরহাটসহ ১০ জেলায় সাদা সোনা’ খ্যাত শত শত টন চিংড়ি মাছ প্রতিদিন লেনদেন ২০ কোটি

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে  বাগেরহাটসহ ১০ জেলায় বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত বড় চিংড়ি বিপণন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত  বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের ফলতিতা বাজার। বাগেরহাটসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত টন মাছ আসে এখানে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় প্রতিদিন এখানে লেনদেন হয় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। মাছের ঘের মালিক, আড়তদার ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের জমায়েতে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে এ এলাকা। ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ি এখানকার আড়তের প্রধান মাছ। তবে রুই, কাতলা, মৃগেল, কার্প, ট্যাংরা, পারসে, ভেটকি প্রভৃতি মাছও বিকিকিনি হয়।

প্রতিদিন লক্ষ কোটি টাকার হাতবদল হয় ফকিরহাটের ফলতিতা বাজারে। মোড়েলঞ্জ, শরণখোলা, কচুয়া, রামপাল, মংলা, রূপসা, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে খুদ্র ব্যবসায়ী ও মস্য চাষীরা মাছ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে এখানে।

এ হাট থেকে মাছ সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রির জন্য নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। বিদেশে রপ্তাতি করার জন্যও এখান থেকে মাছ কেনেন রফতানি কারকরা। বাজারে মূল বিকিকিনি, হাঁকডাক চলে দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত। এরপর চলে মাছ বাছাই, প্যাকেটিং, টুকটাক বেচাকেনা। বিকেল ৫টার দিকে মোকামের সিংহভাগ আড়তে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এই বাজার থেকে গলদা ও বাগদা চিংড়ি ককশিটে ভরে প্যাকিং করে সরাসরি থ্যইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রফতানি করা হয়ে থাকে। জুন, জুলাই ও অক্টোবর মাসে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি মেলে এ হাটে। বিশাল সাইজের গলদা, বাগদা, বিভিন্ন প্রজাতির ঘেরের মাছ একসঙ্গে যারা দেখতে চান তাদের জন্য সুন্দর একটি পর্যটন ফকিরহাটের ফলতিতা বাজার। এ আঞ্চলে চিংড়ী চাষের সুদিন শুরু হয় আশির দশকে। ওই সময়ও মানুষের অভাব ছিল অনেক বেশি। ঠিকমতো খাওয়া হতো না। কিন্তু ফলতিতায় গড়ে ওঠা মৎস্য আড়তের হাত ধরেই পরিবর্তনের সূচনা। নব্বইয়ের দশকে এসে এ আড়তের নাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। এখানকার মানুষের সততা, নিষ্ঠাই ঘুরিয়েছে তাদের উন্নতির চাকা।বাগেরহাট মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কৃষি জমির মধ্যে ৩৯ হাজার ৭৫টি বাগদা চিংড়ি ঘের ও ৩৪ হাজার ২শ ৪৮টি গলদা চিংড়ি ঘের রয়েছে।কয়েকজন চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী  জানান, সরকার চিংড়ি মাছ রপ্তানি করে শত শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও চিংড়ি উৎপাদনকারীদের সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। উপজেলা মৎস্য অফিসও চিংড়ি চাষীদের সচেতন করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয় না।  মৎস্য বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকায় ২০১৯-২০ অর্থ বছরের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১লাখ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানির মাধ্যমে ৫ হাজার ২ শ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্জিত রাজস্বের পরিমাণ আগের সকল রেকর্ড ভেঙেছে।

অর্থ বছরের শেষ নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৬হাজার কোটি টাকা বলে সূত্র জানায়।খুলনার বাগদা চিংড়ি চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ২য় প্রকল্পের পরিচালক ড. নিত্যানন্দ দাস  বলেন, ‘ভাইরাসের প্রকোপ থেকে ঘেরগুলোকে নিরাপদ রাখা গেলে, চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ আরো বাড়তে থাকবে। আর সে ক্ষেত্রে  বছরে চিংড়ি খাতে সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।’

এদিকে, মৎস্য বিভাগের এক গবেষণা পত্রে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে চিংড়ি সম্পদের জন্য ভাইরাস একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর ভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে চিংড়ি সম্পদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়। তবে, দেশে কী পরিমাণ চিংড়ি ভাইরাস আক্রমণের শিকার, সে বিষয় নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য জানা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে বাগদা চিংড়ি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক ড. নিত্যানন্দ দাস  বলেন, ‘এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা কাজ হয়েছে বলে জানা যায়নি। তবে, পাশের দেশগুলোর পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ধারণা করা যেতে পারে যে,  ৫ থেকে ৬ প্রজাতির ভাইরাস দেশের চিংড়ি সম্পদের ক্ষতির কারণ।

এর মধ্যে wssv (হোয়াইট ষ্পট সিনড্রোম ভাইরাস), Tsv (টাউরা সিনড্রোম ভাইরাস), YHV (ইয়েলো-হেড ভাইরাস), MBV (মনোড্রন বেকুলা ভাইরাস), HPV (হেপাটো-পেনক্রিয়াটিক পারভো-লাইফ ভাইরাস) ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়।’

তিনি বলেন, ‘তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এদের মধ্যে ডঝঝঠ-এর সংক্রমণে সৃষ্ট ক্ষতির পরিমাণ সর্বাধিক।

ড. নিত্যানন্দ দাস আরো বলেন,  ‘বাংলাদেশে চিংড়ি শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণজনিত সমস্যাই একমাত্র সমস্যা নয়, উপযুক্ত পরিবেশ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সমন্বয় সাধনও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।’

এদিকে, চিংড়ি চাষীরা জানিয়েছেন, কী কারণে মাছ মারা যাচ্ছে, তা তাদের জানা নেই। মাছ ধরতে গেলে দেখা যাচ্ছে, জালে কোনো মাছ নেই। এরপরই তারা বুঝতে পারেন যে, ঘেরে ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। যদিও মৎস্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে চিংড়ি চাষীদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা হচ্ছে। কিন্তু চিংড়ি চাষীদের জিজ্ঞাসা, তাহলে কর্মকর্তারা কাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আর কাদেরই-বা সচেতন করছেন!রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৭০৬ টন চিংড়ি রপ্তানি করে ৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার আয় হয়। আর সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতের আয় আরও ৪ কোটি ডলার কমে যায়। ৪০ কোটি ৪৭ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৫ কোটি ডলারের চিংড়ি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও ঘাটতি থেকে যায় ৯.১৮ শতাংশ। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম।

বাগদা, গলদাসহ মাত্র পাঁচ প্রজাতির চিংড়ি চাষ করা হয় দেশে। প্রকৃতি ও চাষ এ দুই উৎস থেকে এক মৌসুমেই প্রায় ৩ লাখ টন চিংড়ি পাওয়া যায়। যার চার ভাগের এক ভাগ রপ্তানি হয় আর বাকিটা দেশের চাহিদা পূরণ করে। উৎপাদিত চিংড়ি যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়ামে রপ্তানি হয়। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় বেলজিয়ামে।

বাংলাদেশে চিংড়িকে বলা হয় সাদা সোনা। আন্তর্জাতিক বাজারে অসম প্রতিযোগিতা ও দেশের বাজারে উৎপাদন কমাসহ বিভিন্ন সংকটে পড়েছে দেশের চিংড়ি রপ্তানি বাজার। এর ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে সাদা সোনা বা হোয়াউট গোল্ড খ্যাত এ পন্যের রপ্তানী আয়।

চিংড়ি রপ্তানি আয় কমার পেছনে সংশ্লিষ্টরা আন্তর্জাতিক বাজারের অসম প্রতিযোগিতাকেই বেশি দায়ি করেন। প্রতিযোগী দেশগুলো কম দামের চিংড়ি বেশি উৎপাদন করছে আর কম দামে বাজারে সরবরাহ করছে। যেহেতু বাংলাদেশের গলদা ও বাগদা চিংড়ি ব্যাপক হারে চাষ হয়। উন্নত মানের এ চিংড়ির দামও বেশি। তাই দেশের চিংড়ির বাজার হুমকির মুখে পড়ছে।

অপরদিকে, প্রতিযোগী দেশ ভারত ও ভিয়েতনাম বিকল্প জাত ভেনামি চিংড়ি চাষ করে। বাগদা চিংড়ির তুলনায় ভেনামি চিংড়ির দাম অনেক কম এবং উৎপাদন বেশি হয়। বাগদা চিংড়ির চেয়ে ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম হয়। রপ্তানিতেও পাউন্ডে দুই ডলার কম হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা ভেনামি চিংড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আর বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনে অনুমতিও নেই। আবার সেমি ইনসেন্টিভ প্রযুক্তিতে যে চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই মারা যাচ্ছে আবহাওয়ার কারণে। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওজনে বেশি দেখানোর জন্য চিংড়িতে অপদ্রব্য ঢুকিয়ে (পুশ) রপ্তানি করে যা দেশের বাজার নষ্ট করছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্য মতে, গত চার বছরের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির হার ক্রমাগত কমছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৬৩৫ টন চিংড়ি রপ্তানি করে ৫৫ কোটি ডলার আয় হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ২৭৮ টন চিংড়ির বিপরীতে আয় হয় ৫১ কোটি ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ হাজার ২৭৬ টন চিংড়ি থেকে আয় আসে ৪৫ কোটি ডলার। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে গেল চার বছর ধরে চিংড়ির রপ্তানি কমছে।

চিংড়ি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানী পর্যন্ত আট থেকে ১০ ধাপ পার হতে হয়। এতে মাঠের চাষীরা দাম পায় অনেক কম। এছাড়া চিংড়ি রপ্তানিকারকদের নিয়েও চাষীদের আছে নানা অভিযোগের জায়গা। বছরের প্রায় তিন মাস সমুদ্রে মা চিংড়ি আহরণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় হ্যাচারিগুলো মা চিংড়ি পাচ্ছে না। চাষিদের কাছেও প্রয়োজনমত চিংড়ি পোনা পৌঁছায় না। তাই উৎপাদন কমে গেছে অনেকাংশে। কিন্তু এ খাতকে ধরে রাখতে হলে বা আগের অবস্থান ফিরে পেতে হলে রপ্তানি বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তরান্বিত করার পাশাপাশি বাড়াতে হবে উৎপাদনও।

বিকল্প হিসেবে দেশে বাগদার উৎপাদন খরচ কমানো যেতে পারে। অথবা দেশে ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু করা যেতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনে সরকারিভাবে অনুমতি না থাকায় উৎপাদনও করতে পারে না চাষিরা। তাই চিংড়ি রপ্তানি বাড়াতে প্রয়োজন কিছু পদক্ষেপ। দরকার সরকারি-বেসরকারি হস্তক্ষেপ।

রপ্তানি বাড়াতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে চিংড়ি চাষীদের আগ্রহ। চিংড়ি চাষ ও বাণিজ্যের সাথে দেশের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বিদেশে চিংড়ি রপ্তানী দেশে চিংড়ি চাষীদের সবচেয়ে বড় উৎসাহ জোগায়। কিন্তু যেখানে রপ্তানির জৌলুসটাই তাদের চিংড়ি চাষে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। সেই রপ্তানির চিত্রও যখন হতাশাব্যঞ্জক, তখন দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্দ্যোগ না নিলে দেশের মাটিতে চিংড়ি চাষও হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)