পাটকেলঘাটায় সমবায় সমিতির নামে চলছে প্রতারণা
মধ্যযুগে মানুষের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে চড়া সুদে টাকা ধার দিয়ে জবর দখল করে তাদের সম্পত্তি গ্রাস করত মহাজনরা।লেখাপড়া না জানা গ্রামের সহজ সরল মানুষদের কাছ থেকে সাদা কাগজে টিপ সই নিয়ে সুদে টাকা ধার দিত সে যুগের সুদে কারবারি মহাজনরা। সাদা কাগজে টিপ সই দিয়ে টাকা নেওয়ার পরবর্তীতে কি করত সুদে মহাজনরা সেটাও আমরা গল্পে শুনেছি।
সুদের টাকা পরিশোধ করার পরও গরীব অসহায় মানুষদের শেষ সম্বল বসত ভিটা যেত মহাজনদের দখলে। মধ্যযুগের সেই বর্বরতাকে হার মানিয়ে বর্তমানে সাধারণ মানুষদের নিঃস্ব করছে পাটকেলঘাটা শ্রমজীবী সঞ্চয় ও ঝণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড ও পাটকেলঘাটা সমবায় সমিতি। ঝন দেওয়ার নামে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে সাদা স্ট্যাম্প ও সই করা চেক বইয়ের পাতা।
স্থানীয় অনেকে জানান, সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা বাজারে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওই দু’টি সমিতি। দীর্ঘ ১৪ বছর যাবত চড়া সুদে ঝন দিয়ে গরীব অসহায় মানুষদের মধ্যযুগীয় মহাজনদের মত নিঃস্ব করছে সমবায় সমিতির পরিচালকরা।সমবায় অধিদপ্তরের সরকারি পরিপত্রের তোয়াক্কা না করেই সদস্যদের কাছ থেকে অতিরিক্ত সুদ আদায়, সাদা চেক ও স্ট্যাম্প নিয়ে থাকে এই প্রতিষ্ঠান এমনই অভিযোগ স্থানীয়দের।
টাকা পরিশোধ করার পরও চেকের পাতায় নিজেদের ইচ্ছা মত টাকা বসিয়ে আদালতে মামলা করে গ্রাহক হয়রানির ও শত শত অভিযোগ আছে পাটকেলঘাটা সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে নিরীহ মানুষদের চড়া সুদের জালে পেঁচিয়ে নিঃস্ব করে ছাড়ছে ওই সমিতি। এমনকি তাদের বৈধ সরকারি অনুমোদন ছাড়াই চলছে পাটকেলঘাটা সমবায় সমিতি।
পাটকেল-ঘাটা শ্রমজীবী সমবায় সমিতির সদস্যদের মধ্যে অনেকে অভিযোগ করে বলেন, অনিয়ম দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চলছে শ্রমজীবী সমিতি।চড়া সুদের ফাঁদে ফেলে ঝনের ৫ গুণ টাকা আদায় করা তাদের প্রধান কাজ। পাটকেলঘাটা শ্রমজীবী সঞ্চয় ও ঝণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড গ্রাহকদের ক্ষুদ্র ও বড় আকারে ঝন দিয়ে থাকে। সমিতির নিয়ম অনুযায়ী ঝন নিতে হলে গ্রাহককে ওই সমিতির সদস্য হতে হবে। লোন নিতে হলে সেখানে সঞ্চয় করতে হবে টাকা।
এরপর সমিতি সদস্যদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঝন দিয়ে থাকেন সমিতি কর্তৃপক্ষ। তবে ঝন গ্রহণ করতে হলে সমিতির কর্মকর্তাদের দিতে হয় একটি সাদা চেক ও স্ট্যাম্প।ওই চেক আর স্ট্যাম্প নিয়ে গ্রাহক হয়রানি থেকে শুরু করে অতিরিক্ত অর্থ ও আদায় করেও থাকে সমবায় সমিতি কর্মকর্তারা।ঝন নিয়ে পাঁচ গুণের ও বেশি টাকা পরিশোধ করে মামলা থেকে রেহায় পাইনি অনেক গ্রাহক।
আরিফুল নামের অবসর প্রাপ্ত সরকারি কৃষি কর্মকর্তা জানান, তিনি সমিতি থেকে ঝন না নিয়েও জেল খেটেছেন। একটি চেকের পাতা নিয়ে তার একজন আত্নীয় কয়েক বছর আগে শ্রমজীবী সমবায় সমিতি থেকে ১ লক্ষ টাকা ঝন নেয়। কয়েকটি কিস্তি দিয়ে ঝনের কিছু টাকা পরিশোধ করতে পারেনি সে। পরবর্তীতে চেকের পাতাই ১২ লক্ষ টাকা লিখে সমিতির কর্মকর্তারা সাতক্ষীরা আদালতে একটি মামলা করে। মামলায় রায়ে আদালত তাকে টাকা পরিশোধ না করার কারণে ৬ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। বাধ্য হয়ে আদালতের মাধ্যমে ৬ লক্ষ টাকা দিয়ে জামিন নিয়ে বেড়িয়ে আসেন তিনি। এরপর আরও ৬ লক্ষ টাকা পরিশোধ করতে হবে টাকা না নিয়েও সমিতির বেড়াজালে ফেঁসে গেছেন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। জীবনের শেষ সম্বল পেন শিয়ানের টাকা শ্রমজীবী সমিতির হাতে তুলে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে দিন কাটাচ্ছেন আরিফুল ইসলাম । তারপরও বাকী টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন জানা নেই তার।
মর্জিনা নামের এক মহিলা সদস্য জানান, পাটকেলঘাটা শ্রমজীবী সমিতি থেকে সে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ছিলেন। টাকা পরিশোধ করে দেওয়ার পরও তার নামে ১ লক্ষ টাকার মামলা করেছে। সাদা চেক নেওয়ার কারণে নিজেদের ইচ্ছামত টাকার অংক বসিয়ে তার নামে ১ লক্ষ টাকার মিথ্যা মামলা করেছে ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
ছাদেকুর রহমান নামে একজন হতদরিদ্র জানান, পাটকেলঘাটা শ্রমজীবী সমবায় সমিতি থেকে ঝন নিলে ৩৬% হাড়ে তাদেরকে সুদ দিতে হয়। অন্য সদস্যদের মত তিনিও ৫০ হাজার টাকা ঝন নিয়ে ছিলেন। সমিতির সুদসহ সমুদয় টাকা পরিশোধ করে দেওয়ার পরও তার নামে ৩ লক্ষ টাকার মামলা দিয়েছে শ্রমজীবী সমবায় সমিতি। টাকা পরিশোধ হওয়ার পরও মামলা দেওয়ার কারণ জানতে সমিতিতে তিনি গেলে তাকে সাধারণ সম্পাদক বলেন আপনি ৩ লক্ষ টাকা নিয়েছেন এজন্য মামলা দিয়েছি।এসময় তিনি বলেন আমিতো ৫০ হাজার টাকা নিয়েছি তাহলে ৩ লক্ষ টাকার মামলা দিয়েছেন কেন?। এমন প্রশ্নের উত্তরে পাটকেল-ঘাটা শ্রমজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন আদালতে কথা হবে এখানে নয়।
পাটকেলঘাটা শ্রমজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন,গরীবের রক্ত চুষে খাচ্ছে ওই সমিতি। সাদা চেক নিয়ে ইচ্ছামত টাকা অংক বসিয়ে সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। ওই খানে পরিচালকের মাসিক বেতন ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকা। সভাপতির বেতন ৫০ হাজার ও সাধারণ সম্পাদকের ৪৫ হাজার টাকা। এমন ভাবে কমিটির সবাই উচ্চ বেতন নেন ওই সমিতি থেকে। এছাড়া সেখানে যেসব কর্মী আছে তাদের ১৫ হাজারের উপরে বেতন প্রদান করে প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতন ১ লক্ষ টাকা আছে কিনা সেটাও জানা নেই। সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা।
এসকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে পাটকেল ঘাটা শ্রমজীবী সমিতিতে গেলে সাংবাদিকদের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণ করেন সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত কুমার ঘোষ। তিনি পাটকেলঘাটা শ্রমজীবী সমিতির কোন তথ্য সাংবাদিকদের দিতে অস্বীকার করেন। এসময় সাংবাদিকদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী।
প্রতিষ্ঠানের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান বৈধ ভাবে চলছে বলে তিনি জানান। সদস্যদের ঝন দেওয়ার জন্য সাদা চেক নেওয়ার বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। কড়া সুদের বিষয়ে তিনি মুখ খুলতে রাজী হননি। তবে তাদের প্রতিষ্ঠানে ১৩ হাজার সদস্য আছে বলে তিনি জানান।
এসকল অভিযোগের বিষয় এবং গ্রাহক হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সমবায় অফিসার(ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা মোঃ হাসান মাহমুদ বলেন, পাটকেলঘাটা সমবায় সমিতি গ্রাহকদের হয়রানি করছে সেটা তিনি অবগতনন। এছাড়া তার কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেনি। গ্রাহকদের ঝন দানের ক্ষেত্রে কোন সমবায় সমিতি সদস্যদের কাছ থেকে ফাঁকা চেক অথবা ষ্ট্যাম্প নিতে পারবেনা। সাতক্ষীরায় অবস্থিত কোন সমবায় সমিতি যদি কোন গ্রাহকের কাছ থেকে চেক কিংবা ষ্ট্যাম্প নিয়ে থাকে তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সমবায় আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান তিনি। এছাড়া পাটকেলঘাটা সমবায় সমিতি যদি কোন গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করে থাকে তাহলে লিখিত অভিযোগ পেলে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা করবেন।