কলারোয়ায় যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘হানাদার মুক্ত দিবস’ পালিত

শুক্রবার যথাযোগ্য মর্যাদায় কলারোয়ায় ‘হানাদার মুক্ত দিবস’ পালিত হয়েছে। কলারোয়া উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল’র যৌথ আয়োজনে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়েছে। সকাল ৮টায় জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে কলারোয়া মুক্ত দিবসের কর্মসূচির শুভ সূচনা করা হয়।

পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ একাত্তরের বেশে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার বিজয় র‌্যালি শেষে কলারোয়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।এসকল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তালা-কলারোয়ার সংসদ সদস্য এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরএম সেলিম শাহনেওয়াজ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য বিএম নজরুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহম্মেদ স্বপন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু, থানা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রাজিব হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধকালীন কমান্ডার আ.গফ্ফার, মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আলী, মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা আ.রউফ, জনপ্রতিনিধি, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ।

সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ক.পা.ই সাধারণ সম্পাদক এড. শেখ কামাল রেজা।উল্লেখ, ৬ ডিসেম্বর কলারোয়া পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে হটিয়ে অবরুদ্ধ কলারোয়াকে হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করে। সূত্রমতে, মহান মুক্তিযুদ্ধের কলারোয়ায় ৩শ’৪৩ জন বীর সন্তান অংশ নেন। শহীদ হন ২৭জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এর মধ্যে কলারোয়ার বীর সন্তান রয়েছে ৯জন। আর এ পর্যন্ত কলারোয়ার ৮টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে কলারোয়ায় পাকিস্তান বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয় ৬টি স্থানে। প্রতিটি যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাকিস্তানিবাহিনীকে পরাস্ত করেন। কলারোয়া অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শতাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত প্রবাসী সংগ্রাম পরিষদ। এই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন প্রাক্তন এমসিএ সর্বজন শ্রদ্ধেয় মমতাজ আহম্মেদ, ভাষা সৈনিক শেখ আমানুল্লাহ, সাবেক সংসদ বিএম নজরুল ইসলাম, যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোসলেম উদ্দীন, শ্যামাপদ শেঠ, ইনতাজ আহম্মেদ, মোছলদ্দীন গাইন ও ডাঃ আহম্মদ আলী।

কলারোয়া এলাকাটি ছিলও মুক্তিযুদ্ধের ৮নং সেক্টরের অধীনে। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ পরিচালনা করেন কলারোয়ার দুই বীরযোদ্ধা মোসলেম উদ্দীন ও আব্দুল গফ্ফার। এই দুই বীরযোদ্ধার নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কলারোয়ার বীর সন্তান গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আলী গাজী, আবুল হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও আঃ রউফসহ শতাধিক বীরযোদ্ধা। সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে সংগঠিত রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধে ৬শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হন। কলারোয়ায় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধেই ২৯ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। শহীদ হয় ১৭জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর কলারোয়ার সীমান্ত এলাকা কাকডাঙ্গা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে হানাদাররা কাকডাঙ্গার ঘাঁটি ছাড়তে বাধ্য হয়। অক্টোবরের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের বাগআঁচড়ায় দুঃসাহসিক হামলা চালিয়ে ৭ পাকিস্তানি রেঞ্জারকে হত্যা করেন। কলারোয়ার খোরদো এলাকাও একই সাথে মুক্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। কলারোয়ার বীর যোদ্ধাদের ধারাবাহিক সফল অপারেশনের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাকিস্তান বাহিনী। কিন্তু পাক বাহিনী যখন বুঝতে পারে পরাজয় নিশ্চিত, তখন তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর চেষ্টা করে। এরই অংশ হিসেবে ৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে কলারোয়ার বেত্রবতী নদীর লোহার ব্রিজ মাইন দিয়ে ধ্বংস করে পাকিস্তানিসেনারা পালিয়ে যায়।

এভাবে দীর্ঘ ৯ মাস কলারোয়ার বিভিন্ন স্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে অবশেষে ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা কলারোয়া ছাড়তে বাধ্য হয়। ৬ডিসেম্বর এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা কলারোয়াকে মুক্ত করেন। সাথে সাথে কলারোয়া থানা চত্বরে স্বাধীনদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। কলারোয়ার স্বাধীনচেতা মুক্তমনের মানুষ উড়ন্ত পাখির মত উড়তে থাকে। ঐতিহাসিক ও গৌরবোজ্জ্বল দিনটি এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে কলারোয়া উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল এবং কলারোয়ার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। বীরবেশে সেদিনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কলারোয়ার মাটিতে দেখতে পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেমিক সন্তানেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। তাঁদের কাছে জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)