মূল্যহীন জীবন ওদের
রাজধানী জুড়ে শুধুই অট্টালিকা। এই অট্টালিকায় নিরাপদে বসবাস করছেন লাখো মানুষ। যারা এই অট্টালিকা তৈরি করছেন সেই নির্মাণশ্রমিকদের জীবন কতটুকু নিরাপদ? পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি মারা যান নির্মাণশ্রমিক। এ বছরেই এখন পর্যন্ত ১৪৮ জন নির্মাণশ্রমিক ভবন থেকে পড়ে বা বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। নিহত এই শ্রমিকদের কতজন ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন? সেই সংখ্যাও একেবারেই নগণ্য।
গত আট বছর ধরে ঢাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করছেন ময়মনসিংহের ২০ বছরের যুবক জুবায়ের হোসেন। গত ৩০ অক্টোবর নির্মাণাধীন ভবনে বিদ্যুত্স্পর্শে শরীরের অনেকাংশ পুড়ে যায় তার। অসহায় হয়ে পড়ে তার পুরো পরিবার। এমন অসংখ্য নির্মাণশ্রমিক প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন দুর্ঘটনার। তাদের নেই হেলমেট, গামবুট, বেল্টসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা। এভাবেই জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। সড়কের পাশে নির্মাণাধীন ভবনেও নেওয়া হয় না পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা। ফলে সেখান থেকেও নির্মাণ সামগ্রী পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারীরাও। কিন্তু কেউই পাচ্ছে না পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্যমতে, বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় কাজ করছেন প্রায় ৩৭ লাখ শ্রমিক। বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণশ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা যেসব শ্রমিকের মৃত্যুর খবর পাই তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করি। আমরা শ্রম মন্ত্রণালয় থেকেও তাদের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। আর অধিকাংশ শ্রমিকের মৃত্যুর খবর তো আমরা জানতেই পারি না। সরকার আইন কড়াকড়ি করলে মালিকরা সচেতন হবেন। তখন এই দুর্ঘটনা কমে যেতে পারে। মালিকরা যদি সচেতন না হন তাহলে কাজ হবে না।’
রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। গত তিন বছরে ৭ হাজার শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের সময় আমরা তাদের ৪ হাজার টাকা করে ভাতা দিয়ে থাকি।’ ৩৭ লাখ শ্রমিকের মধ্যে তিন বছরে মাত্র ৭ হাজার শ্রমিককে প্রশিক্ষণ? এটা একেবারেই নগণ্য কি না জানতে চাইলে শামসুল আলামিন বলেন, ‘অবশ্যই নগণ্য। আমরা এই সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রশিক্ষণ সেন্টার তো খুবই কম। চাইলেও সংখ্যা বাড়াতে পারছি না। এই কারণে আমরা বিভিন্ন ডেভলপার কোম্পানির সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি।
যাতে তারা নির্মাণাধীন ঐ ভবনটিতে সঠিক আইনকানুন মেনে শ্রমিকদের কাজ করান।’ তবে রিহ্যাব সভাপতি স্বীকার করেন, তাদের সংগঠনের বাইরেও বহু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আছে। যাদের প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকরা ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। রিহ্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতি শ্রমিককে ২ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও জানান তিনি। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকেও কিছু টাকা নিয়ে দেওয়া হয়।
তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জাফরুল হাসান বলেন, এই ক্ষতিপূরণ খুব বেশি মানুষ পাচ্ছেন না। যারাও বা পাচ্ছেন টাকার পরিমাণ খুবই কম। আমরা তো বহু শ্রমিকের মৃত্যুর কথা জানিই না। তাহলে তারা কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন? আসলে নিরাপত্তাব্যবস্থা না করে ভবন নির্মাণের এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদেরও সচেতন করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক