বাংলাদেশের এই গ্রামে ২০০ বছরেও ঢোকেনি পুলিশ
গ্রামটির ইতিহাসে কখনো হয়নি মারামারি। জমি নিয়ে বিরোধ বা কারো সঙ্গে মারামারি কোনো কিছুই সচরাচর ঘটে না। গ্রামবাসীরা কখনো আদালতের পথে পা বাড়াননি। নিয়মতান্ত্রিক নিজস্ব আদালতের মাধ্যমে নিস্পত্তি করেই অভ্যস্ত তারা। এ যেন এক রূপকথার গ্রাম!
ভাবতে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন, এমনও গ্রাম রয়েছে তাও আবার এদেশে! এত সুন্দর মানুষও আছে এ দেশে! এত সুন্দর গ্রাম আছে! গ্রামের চারপাশে চলনবিল এর ভেতর দিয়েই একটা সভ্য জাতী গড়ে উঠেছে কেউ তা টের পায়নি! বাংলাদেশ সরকারকে আলাদা কর্ম চাপে ফেলে দেয় না। প্রতিটা জমির খাজনাপাতি ঠিক সময়ে পরিশোধ করে। এ গ্রামে কখনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। সবাই শিক্ষিত। তারা কেউ কেউ ফসল ফলায়, বিদেশে থাকে, অথবা চাকরি করে। এ গ্রামে শিক্ষিতর হার শতভাগ।
বলছি নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রাম সম্পর্কে। এর আয়তন ৫২৮ দশমিক ৪৬ কি.মি. বা (২০৪ দশমিক ০৪ বর্গমাইল)। জনসংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। গত দু’শ বছর ধরে নিজস্ব গণতান্ত্রিক শাসন আর বিচার ব্যবস্থা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে গ্রামটি। এই গ্রামে রয়েছে নিজস্ব সংবিধান। গ্রামটিতে ঢুকতেই আপনার চোখে পড়বে নীল রঙা একটি গেইট। তাতে লেখা ‘আদর্শ গ্রাম’।
এমনকি উচ্চ ও নিম্ন আদালতও। সব ধরনের বিরোধ এর মীমাংসা হয় সেখানেই। এই গ্রামে দু’শো বছরের ইতিহাসে কখনো পুলিশ ঢোকেনি। কোন মামলা আদালতে যায়নি। এ গ্রামে আলাদা একটা গণতান্ত্রিক প্রথা চালু আছে। উন্নয়ন ও বিচার ব্যবস্থাসহ গ্রামের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন একজন চেয়ারম্যানসহ ২৩ সদস্যের হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ।
১৯৩৫ সালে গঠিত হয় এ পরিষদ। বর্তমানে হুলহুলিয়ার চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ। ১৯৫৭ সালে গঠিত তাদের নিজস্ব সংবিধান আছে। ১১ টি পাড়া নিয়ে এ গ্রাম গঠিত। তারা নিজেদের উন্নয়ন নিজেরা করে। নিজস্ব সংসদীয় কমিটি আছে যারা গ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করে। অসাধারণ সভ্য এ গ্রামটি। এ গ্রামের একটা রাজধানী আছে। সেখানকার স্যানিটেশন ব্যবস্থা যেমন আধুনিক তেমনি বাল্য বিয়ে ও যৌতুকের প্রচলনও নেই। এমনকি স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত গ্রামটির কোনো মানুষের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলাও হয়নি। সেখানে সব বিরোধ মীমাংসা হয় সমঝোতার ভিত্তিতে।
এ এক আশ্চর্য গ্রাম, যেখানে শিক্ষার হার শতভাগ। নেই একজনও নিরক্ষর। বরং অধিকাংশই উচ্চশিক্ষায় আলোকিত। এসএসসি পাস যারা, তারা বিবেচিত ‘অর্ধশিক্ষিত’ হিসেবে। নিসর্গ-সৌন্দর্যে ঘেরা এ গ্রামে শীতে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। তবে পাখি মারার প্রবণতা নেই গ্রামবাসীর। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বশাসন ব্যবস্থা চলে আসছে এখানে। ১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রামের সর্বোচ্চ আদালতের পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। এখনও সেই বিচার ব্যবস্থা চলমান।
আরও বিস্ময়কর যে, সারাদেশ যখন রাজনৈতিক বিভাজনে বিরোধে বিভক্ত, তখনও এই গ্রামে রাজনীতি সৃষ্টি করেনি বিরোধ-বিবাদ! নিশ্চয়ই বিস্মিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, একুশ শতকের এই সংঘাতমুখর বাস্তবতায় এমন গ্রামও আছে এ দেশে! এখানেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক আছেন বটে। কিন্তু নেই দলবাজি। নেই বিরোধ। সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের। উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির। ইউপি চেয়ারম্যান জামায়াতের। নির্বাচনী প্রচারে নেতারা আসেন জেলা, উপজেলা থেকে। কিন্তু গ্রামবাসী নীরবে যে যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। প্রকাশ্য কোনো দলাদলি নেই। রূপকথার মতো শোনালেও হুলহুলিয়া বাস্তবেই এক বিস্ময়কর গ্রাম।
সিংড়ার চৌগ্রাম ইউনিয়নের হুলহুলিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ‘নিয়ামত খাল’ নামের একটি ছোট নদী, যা আত্রাই নদীতে গিয়ে মিশেছে। বর্ষা মৌসুমে চলনবিলের কোলের এই গ্রামের চারদিকে পানিতে থই থই করে। এ সময় সমুদ্রের আকার ধারণ করা চলনবিলের পানির বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে গ্রামের চারদিকে। তবে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক সময় খুব খারাপ ছিল। ছিল না কোনো রাস্তাঘাট। নৌকাই ছিল বর্ষা মৌসুমের প্রধান বাহন। এখন থানা সদরের সঙ্গে পাকা সড়ক নির্মাণ হওয়ায় চলাচল সহজ হয়েছে।
প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস এই গ্রামে। ভোটারের সংখ্যা এক হাজার ৩৫০। ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামের একটি সর্বোচ্চ পরিষদের মাধ্যমে এই গ্রামের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। একজন চেয়ারম্যান ও একজন সহকারী চেয়ারম্যানসহ এ পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৩। গ্রামবাসীর ভোটে এ কমিটির সদস্যরা নির্বাচিত হন। প্রতি দু’বছর পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।