ডাক্তারের ভুলে পাকিস্তানের এক শহরে ৯০০ শিশু এইডস আক্রান্ত

পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের শহর রাতোদেরোতে এইচআইভি টেস্টে প্রায় ৯০০ শিশুর ফল ‘পজিটিভ’ এসেছে। শিশুদের এভাবে এইডস আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় সিন্ধ প্রদেশের শহরটিতে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এই ‘বিপর্যয়ের’ জন্য জ্বরাক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় সিরিঞ্জ পুনর্বার ব্যবহারকারী এক চিকিৎসককে দায়ী করা হচ্ছে। তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম জানায়, এখন পর্যন্ত ওই শহরের ১১শ’ মানুষের এইচআইভি টেস্ট পজিটিভ এসেছে। এদের মধ্যে প্রায় ৯শ’ শিশু রয়েছে, যাদের সবার বয়স ১২ বছরের কম।

স্থানীয় এক সাংবাদিক গুলবাহার শেখ সর্বপ্রথম রোটাডেরোর এই বিভীষিকার খবর সামনে আনেন। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য মন্ত্রক। যদিও সরকারি পরিসংখ্যান বলছে এইচআইভি আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা আনুমানিক ৫০০, কিন্তু গুলবাহার শেখের তথ্য বলছে, গত কয়েকমাসে শুধুমাত্র রোটাডেরোতেই এইচআইভি আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৯০০ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তদের প্রত্যেকের বয়স ১২ বছরের নীচে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩৫ জনের। বাকিরা মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে।

এইচআইভি মহামারীর রূপ নেয় গত এপ্রিলেই

গত এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে সিন্ধু প্রদেশের লারকানা অঞ্চল লাগোয়া ওয়াসাও গ্রামে কয়েকজন এইচআইভিতে আক্রান্ত হন। ধীরে ধীরে সেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে।  শতাধিক মানুষের আক্রান্তের হওয়ার খবর মেলে। এইচআইভি সংক্রমণ ছড়ায় আশপাশের গ্রামগুলিতেও। ঘরে ঘরে কান্নার রোল ওঠে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি জানায়, এই আক্রান্তদের মধ্যে মহিলা ও শিশুর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অভিযোগ ওঠে, স্থানীয় কিছু ‘হাতুড়ে’ ডাক্তারদের গাফিলতিতেই এমন ঘটনা ঘটেছে। কোনও ভাবে টীকাকরণের সময় বা শিশু-মহিলাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার সময়ে সংক্রামিত সিরিঞ্জ ব্যবহার করেছিলেন ওই ডাক্তাররা। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে চড়াও হন গ্রামবাসীরা। ভাঙচুর-বিক্ষোভ চলে। কিন্তু এইচআইভির এই মহামারীতে লাগাম পরানো যায় না। ফলে হুহু করে বাড়তে থাকে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা।

শত শত শিশুকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ এই ডাক্তারেরই বিরুদ্ধে

সিন্ধু প্রদেশের ‘শিশু হত্যাকারী’ বলে ডাকা হচ্ছে ডাক্তার মুজফফর ঘাঙরোকে। অভিযোগ এই ডাক্তারের গাফিলতি এবং দুরভিসন্ধিতেই প্রায় একটা গোটা প্রদেশের বাবা-মায়েরা সন্তানহারা হতে চলেছেন।

ডাক্তার মুজফফর ঘাঙরো

একটা সময় ঘাঙরোর পরিচয় ছিল গরিবের ডাক্তার। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সরকারি সমস্ত হাসপাতালে নামমাত্র টাকায় রোগী দেখতেন তিনি। সাংবাদিক গুলবাহার জানিয়েছেন, একটি দু’বছরের শিশুকে টীকা দেওয়ার সময় পুরনো সিরিঞ্জ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তার থেকেই ছড়ায় এই সংক্রমণ। এর পর আরও শয়ে শয়ে শিশু ও মহিলার স্বাস্থ্যপরীক্ষার সময়ে সংক্রামিত সিরিঞ্জই ব্যবহার করেছিলেন ডাক্তার। অভিযোগের আঙুল ওঠার পরেও অপরাধ স্বীকার করেননি তিনি। উল্টে দোষ দিয়েছিলেন স্থানীয়দের অসংযমী জীবনযাত্রার উপর। ডাক্তারকে গ্রেফতার করা হলেও, পরে প্রমাণের অভাবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

গ্রামবাসীদের দাবি, ডাক্তার ঘাঙরো এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বরং তাঁর বদলি হয়েছে সরকারি হাসপাতালের উঁচু পদে। ক্ষমতাও বেড়েছে। তাঁকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। উল্টো সুরে গেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রকও বিবৃতি দিয়েছে, “ডাক্তারের কোনও দোষ নেই। পথচলতি সেলুনগুলিতে পুরনো রেজারই ব্যবহার করেন নাপিতরা। হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তাররা পরিচ্ছন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন কি? তাহলে এত প্রশ্ন উঠছে কেন?”

সিন্ধু প্রদেশে মৃত্যুর ছায়া, বুকফাটা আর্তনাদ সন্তানহারাদের

ছয় সন্তানের দু’টিকে হারিয়েছেন ইমতিয়াজ জালবানি। ১৪ মাসের রিডা ও তিন বছরের সামিনা। বাকি চার সন্তানও এইচআইভি আক্রান্ত। মৃত্যুর দিন গুনছে। “আমার ছ’বছরের ছেলেকে প্রথম ইঞ্জেকশন দেন ওই ডাক্তার। তারপর বাকিদের ক্ষেত্রেও ওই একই সিরিঞ্জ ব্যবহার করেন। আমি বাধা দিয়েছিলাম। তাতে রেগে গিয়ে বলেন, না পোষালে অন্য ডাক্তার দেখিয়ে নিতে। আমরা গরিব, অত পয়সা কোথায় পাব,” সন্তানদের বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন ইমতিয়াজ।

ফারজানা বিবির তিন বছরের ছেলেও এইচআইভি পজিটিভ। ছেলেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন ফারজানা। সরকারি হাসপাতালের দোরে দোরে ঘুরছেন। বলেছেন, “ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে এসেছে। কীভাবে মৃত্যুমুখ থেকে বাঁচাবো সন্তানদের?” উত্তরটা জানা নেই কারো।

‘‘আমার মেয়ের জ্বর হয়েছিল। রক্ত পরীক্ষায় দেখা গেল এইচআইভি পজিটিভ। কী করে এমন হলো বুঝতে পারছি না,’’ হাহাকার মুখতার পারভেজের। একই দশা নিশাল আহমেদেরও। তাঁর এক বছরের মেয়ে এইচআইভি আক্রান্ত। তিনি বা তাঁর স্ত্রী এই সংক্রমণের শিকার হয়েছেন কি না সেটা জানতে রক্ত পরীক্ষা করাতে এসেছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘গ্রাম বা আধা শহরগুলিতে রমরমিয়ে ব্যবসা খুলে বসেছে হাতুড়ে ডাক্তাররা। তাদের গাফিলতিতেই এই সংক্রমণ মহামারীর আকার নিচ্ছে। ঘরে ঘরে আক্রান্ত হয়েছে শিশুরা।’’

নিজের নাতি বটেই, পাঁচ সন্তানও এইডস আক্রান্ত কি না সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না বৃদ্ধ ইমাম জাদি। বলেছেন, ‘‘আমার পুরো পরিবার শেষ হতে বসেছে। কে জানে ভাগ্যে কী লেখা আছে।’’

দেশজুড়ে এইচআইভি সংক্রমণের কথা শিকার করে নিয়েছে পাকিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রকও। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, ২০১৭ সালে পাকিস্তানে ২০ হাজার মানুষ এইচআইভি সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। হালে এইচআইভি সংক্রমণে বিশ্বের মধ্যে পাকিস্তানের স্থান দ্বিতীয়। পাক স্বাস্থ্যমন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, এই মুহূর্তে গোটা দেশে প্রায় ৬ লক্ষ হাতুড়ে ডাক্তার রয়েছেন। শুধু মাত্র সিন্ধু প্রদেশেই সেই সংখ্যাটা আড়াই লক্ষের বেশি। সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও যাঁরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে প্রসব থেকে অস্ত্রোপচার সবই করেন। UNAIDS রাষ্ট্রপুঞ্জের সংগঠন জানিয়েছে, এই মহামারী রুখতে না পারলে এবং স্থানীয় ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে, অচিরেই একটা গোটা প্রদেশ শিশু-শূন্য হয়ে যাবে।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)