থাইল্যান্ডে বিপুল সম্পত্তির মালিক তারেকের সাবেক সহচর ‘ক্যাসিনো’ সেলিম
কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাকর্মী থেকে ভোল পালটে টাকার পাহাড় গড়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। একসময় লোকমান বিএনপির রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করা লোকমান আওয়ামী লীগের ১০ বছরে দাপটের সঙ্গে মোহামেডানকে শেষ করে বাণিজ্য করেছেন রমরমা। লোকমানের ক্যাশিয়ার হলেন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সহসভাপতি সেলিম প্রধান।
দৈনিক ইত্তেফাকের আজকের সংখ্যায় প্রকাশিত সাংবাদিক আবুল খায়েরের করা একটি বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল সোমবার অপরাহ্নে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট থেকে সেলিম প্রধানকে র্যাব গ্রেফতার করে। তিনি ব্যাংককে পালিয়ে যেতে থাই এয়ারওয়েজের ঐ ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সেলিম প্রধান ‘প্রধান গ্রুপ’ নামে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের চেয়ারম্যান। এই গ্রুপের অধীনে পি২৪ গেইমিং নামের একটি কোম্পানি আছে, যাদের ওয়েবসাইটেই ক্যাসিনো ও অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসার তথ্য রয়েছে। প্রধান গ্রুপের কোম্পানি জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপার্সের নাম রয়েছে ঢাকা চেম্বারের সদস্যদের তালিকায়। সেলিম প্রধানের অফিসের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে গুলশানে। সেখানেই পি২৪ গেইমিংয়ের অফিস। আর ফেসবুক পেইজে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সেলিম থাকেন থাইল্যান্ডে।
গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সেলিম প্রধান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তার মাধ্যমে তারেক রহমানের কাছে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা পাঠানো হয়। একসময় হাওয়া ভবনে যাতায়াতের মাধ্যমে তারেক রহমানের সঙ্গে সেলিম প্রধানের ঘনিষ্ঠতা হয়।
সেলিম প্রধানের ব্যাংককে নিজের বাড়ি, পাতায়ায় বিলাসবহুল হোটেল, ডিসকো বারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। এদিকে জিজ্ঞাসাবাদে লোকমান ক্যাসিনো ঘিরে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য ও বিদেশে অর্থ পাচারসহ জড়িত অনেকের নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রকাশ করেছেন। তার দেওয়া তথ্য থেকেই বেরিয়ে আসে সেলিম প্রধানের নাম। ঢাকার ক্যাসিনোর টাকা থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করেছেন তিনি।
ক্যাসিনোর টাকায় অর্জিত পুরান ঢাকার তিন ভাই রশিদ, এনু, রুপনের কোটি কোটি টাকার বাড়ি, গাড়ি, ধন-সম্পদের মধ্যে টাকা-স্বর্ণালংকার ভর্তি পাঁচ সিন্দুকের কাহিনী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর মণিপুরীপাড়ার বাসা থেকে লোকমানকে আটক করে র্যাব। এ সময় তার বাসা থেকে ছয় বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়।
বিএনপি ঘরানার লোকমানের বিএনপিপ্রীতি কম নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ২০১৭ সালে লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে একটা বিলাসবহুল বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন লোকমান। এদিকে লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে ফের দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম আশেক ইমাম শুনানি শেষে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন। এর আগে রাজধানীর তেজগাঁও থানার দায়ের করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় দুই দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসামিকে হাজির করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক কামরুল ইসলাম ফের পাঁচ দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর একই মামলায় দুই দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছিল। আগের দিন সন্ধ্যায় র্যাব বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করে।
লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার চাচাতো ভাই কবীর আহমেদ ভূঁইয়া এক সময় মোহামেডানের অর্থ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। দুই জনই ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কবীর ভূঁইয়ার মাধ্যমে ক্যাসিনোর টাকা লন্ডনে পাঠানো হতো। বনানীর উদয় টাওয়ারে তাদের অফিস রয়েছে। কবীর ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, ‘চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করব।’ তিনি বলেন, মাদক, অস্ত্র ও সন্ত্রাসীর বিষয়টি র্যাব দেখবে। মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি র্যাব নয়, সিআইডিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা এ বিষয়টি দেখবে। গুজব ছড়িয়ে, কাল্পনিক ঘটনা তৈরি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে বাধা সৃষ্টি না করার জন্য গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বেনজীর আহমেদ বলেন, বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে, গসিপ ছড়িয়ে কিংবা মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণা প্রচার করে চলমান অপারেশন ভণ্ডুল না করাই ভালো।
এদিকে সেলিমকে গ্রেফতারের পর রাতে গুলশান ২ নম্বরে তার স্পা’য় অভিযান শুরু করে র্যাব-১। র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে গুলশান ২ নম্বরের ৯৯ নম্বর সড়কে ১১/এ নম্বর ‘মমতাজ ভিশনে’ সেলিম প্রধানের একটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অভিযান শুরু হয়।