বন্যা ২০১৯ মোকাবিলা ও ত্রাণ কার্যক্রম- পরিচালনায় শুদ্ধাচারের ঘাটতি; ১৮ দফা দাবি টিআইবির

ঢাকা, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯: বন্যা ২০১৯ মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে উদ্যোগের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, মেরামতের অভাবে বাঁধ নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং বন্যা মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকায় ক্ষতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি, ইউনিয়ন পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণে এনজিও সমন্বয়হীনতা, সাব-কমিটি গঠন ও স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি না করা, দূর্গম এলাকায় সতর্কবার্তা প্রচারের ঘাটতি এবং অধিকতর বিপদাপন্ন পরিবার ও এলাকাকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে প্রাধান্য না দেওয়া, ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সরকারি বরাদ্দ যথেষ্ঠ না থাকা এবং স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা এবং আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বন্যা মোকাবিলা ও ত্রাণ কর্মকা- পরিচালনায় শুদ্ধাচারের ঘাটতি পূরণে ১৮ দফা দাবি সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
‘বন্যা ২০১৯ মোকাবিলায় প্রস্তুতি এবং ত্রাণ কার্যক্রমে শুদ্ধাচার পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ টিআইবির ধানম-িস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বন্যা ২০১৯ মোকাবিলা ও ত্রাণ কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এই সুপারিশসমূহ উপস্থাপন করে টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এস এম জুয়েল, অ্যাসিসটেন্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার, জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম. জাকির হোসেন খান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন জলবায়ু অর্থায়নে পলিসি ও ইন্টিগ্রিটি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মাহ্ফুজুল হক, জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. নেওয়াজুল মওলা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্যোগ মোকাবিলা এবং এর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের পারদর্শিতা ও সুনাম দেশে ও বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ প্রেক্ষিতেই এক্ষেত্রে শুদ্ধাচারের সর্বোচ্চ উৎকর্ষের উত্তরোত্তর বিকাশ অপরিহার্য। এবারের বন্যার প্রেক্ষিতে ত্রাণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায্যতা ও জনঅংশগ্রহণের ঘাটতির পাশাপাশি বন্যা মোকাবিলায় প্রশাসনের সার্বিক তদারকি প্রত্যাশিত সমন্বয় ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া, বন্যাকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় বাজেট, লোকবল ও পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যা আক্রান্ত অন্যান্য স্থানে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে ঘাটতি দেখা গেছে।”
ড. জামান বলেন, “রাজনৈতিক বিবেচনায় ত্রাণ বিতরণের অভিযোগ ছিল, স্বজনপ্রীতির দৃষ্টান্ত, ত্রাণের চাল বরাদ্ধকৃত হারের তুলনায় কম হারে বিতরন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তির পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে অসম ত্রাণ বিতরন, অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থার ঘাটতি, মন্ত্রীর সফর সংক্রান্ত ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক খাতে ত্রাণের সম্পদের ব্যবহার ইত্যাদির ফলে গবেষণার উত্তরদাতাদের বিবেচনায় সরকার ও জনপ্রতিনিধির নিকট সন্তোষজনক ভূমিকা পাওয়া যায়নি।” বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবিলা ও ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য সৃষ্টি হয়েছে ও সরকারের পক্ষ থেকে বন্যা মোকাবিলায় বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সার্বিক অগ্রগতির বিবেচনায় আরো উন্নতির সুযোগ ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বন্যাপ্লাবিত ২৮টি জেলার মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি জেলাÑ কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিলেট এর ২০টি ইউনিয়নের মোট ৬৮৩টি খানায় এ বছরের ৩১ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। গবেষণাভুক্ত ১০টি উপজেলায় ১৮ হাজার ৭১২টি পরিবার সম্পূর্ণ এবং ৩ লাখ ২৬ হাজার ২৫৮টি পরিবার আংশিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। এছাড়া ৩৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে এবং ১ হাজার ২৭৭টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৮৬৩ কি.মি.। বাঁধ সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১.৫৫৪ কি.মি. এবং আংশিক ক্ষতি ৫৩.৬ কি.মি.। এছাড়া ১২ হাজার ১৮৬.৫ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৩২ হাজার ২৩৩ হেক্টর আংশিক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
অন্যদিকে, জরিপকৃত ৯০ শতাংশ খানার ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং খানাপ্রতি গড় ক্ষতি ১৭,৮৬৩ টাকা। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, তৈজসপত্র, আসবাবপত্রের ক্ষেত্রে খানাপ্রতি গড় ক্ষতি ৯৩৭ টাকা এবং মজুদকৃত ধান ও চালের ক্ষেত্রে গড় ক্ষতি যথাক্রমে ১০,৮৩১ এবং ২,৬৩৭ টাকা। এছাড়া ৫৮ শতাংশ খানার গবাদি প্রাণির ক্ষতি হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে খানাপ্রতি গড় ক্ষতি ৮,৯৩০ টাকা। আবার জরিপকৃত ৪৯ শতাংশ খানার নলকূপ এবং ৭৪ শতাংশ খানার ল্যাট্রিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৪৬ শতাংশ খানার কোনো না কোনো ফসলি ক্ষেত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫ শতাংশ খানার মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৩১ শতাংশ খানার ফসলি জমি বালি জমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জরিপে ৯৪ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে পদক্ষেপের ঘাটতি, ৭৩ শতাংশ পরিমানে কম ত্রাণ দেওয়া, ৩২ শতাংশ স্বজনপ্রীতি করার কথা উল্লেখ করেছেন।
সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বন্যার ঝুঁকি যথাযথভাবে চিহ্নিত না করা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে উদ্যোগের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, মেরামতের অভাবে বাঁধ নষ্ট হওয়া এবং বন্যা মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতিতে ঘাটতি কারণে ক্ষতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন, পরিকল্পনা এবং স্থায়ী আদেশাবলী প্রতিপালনে ব্যত্যয় – ইউনিয়ন পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণে এনজিও সমন্বয় না করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে সাব কমিটি গঠন ও স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি না করা, দূর্গম এলাকায় সতর্কবার্তা প্রচার না করা, অধিকতর বিপদাপন্ন পরিবার ও এলাকাকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে প্রাধান্য না দেওয়া, স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা এবং আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব ও চাহিদা নিরূপণ এবং সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার অভাব, ত্রাণ কার্যক্রমে দুর্নীতি ও অনিয়মের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যা আক্রান্ত অন্যান্য স্থানে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে ঘাটতিÑ চিকিৎসা, পানি, স্যানিটেশন, নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা, বন্যা পরবর্তী সময়ে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য সরেজমিন পরিদর্শন এবং জনঅংশগ্রহণমূলক জরিপ পরিচালনা না করা এবং ক্ষতি ও পুনর্বাসন চাহিদার সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি।
বন্যা মোকাবিলা ও ত্রাণ কর্মকা- পরিচালনায় শুদ্ধাচারের ঘাটতি পূরণে তিনটি পর্যায়ে সুপারিশ প্রস্তাব করেছে টিআইবি। বন্যা পূববর্তী পর্যায়ে, জনসংখ্যা অনুপাতে ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা এবং বন্যা শুরুর আগেই সরকার ঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্রসমূহে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিশ্চিত করা; বন্যার ২৪ ঘন্টা পূর্বে সতর্কতা ও নিরাপত্তামূলক বার্তা প্রচার ব্যবস্থা উন্নত করাসহ বন্যা পূর্বপ্রস্তুতি ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করা; ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ও পূর্বপ্রস্তুতি যেমন স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, মহড়া, পরিবহন ইত্যাদি গ্রহণ করা; বর্ষা মৌসুমের আগেই বাঁধ বা বেড়িবাঁধ ও যোগাযোগ অবকাঠামো সংস্কার করা। বন্যাকালীন পর্যায়ে, ত্রাণ ক্রয় ও বিতরণে অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধে স্থানীয় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত অর্থ, ক্রয়কৃত ত্রাণের পরিমাণ ও তালিকা এবং বিতরণকৃত ত্রাণের তথ্য প্রকাশ, প্রশাসন কর্তৃক তদারকি এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; শিশুখাদ্য ও গো-খাদ্য, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় ত্রাণের তালিকা প্রস্তুত করা; ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ভিত্তিতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ; এনজিওসহ সকল অংশীজনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; ত্রাণকার্যে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিতে পরিবহন এবং যাতায়াত বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ। এবং বন্যা পরবর্তী পর্যায়ে, পানিবাহিত রোগ মোকাবিলায় বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা; ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে জরুরি ভিত্তিতে বন্যা পরবর্তী চাহিদা নিরূপণ; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কর্মহীন মানুষের দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে প্রয়োজনীয় বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিতরণ এবং কমিউনিটিভিত্তিক বীজ ব্যাংক ও ভাসমান বীজতলা তৈরিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান – কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ রক্ষায় বীমা পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে; রাস্তাঘাট ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বেড়িবাঁধ সংস্কার ও পুনঃনির্মাণে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করা এবং বন্যাপ্রবণ এলাকার জন্য প্রত্যেক অর্থবছরে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়।
Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)