গ্যাং কালচারে ভয়ংকর কিশোররা
ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ‘গ্যাং কালচার’। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই পাড়া-মহল্লায় কিশোরদের একটি অংশের বেপরোয়া আচরণ স্থানীয়দের জন্যও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে।
ভার্চুয়াল মাধ্যমে গ্রুপ সৃষ্টি করে সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়ানো কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা খোদ রাজধানীতেই অর্ধশতাধিক। গ্যাংগুলো উদ্ভট সব নামে পরিচিত। আড়াই বছর আগে উত্তরার আদনান কবির হত্যার পর এই ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি সামনে এলেও এখন ব্যাপ্তি বেড়েছে। ১৫-১৭ বছর বয়সী প্রতিটি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ১৫-১৭ জন। তবে ১৮-২৪ বছর বয়সী গ্রুপও রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে বেশ কয়েকজন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি জরুরি। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাই যথেষ্ট নয়, চূড়ান্ত দাওয়াই হচ্ছে অভিভাবকদের সচেতনতা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম যুগান্তরকে বলেন, অভিভাবকদের দুর্বল তত্ত্বাবধায়নের কারণে কিশোররা অপরাধের দিকে ঝুঁকছে। রাষ্ট্র বলেন, পুলিশ বলেন, কেউই কোনো কিছু করতে পারবে না।
কিশোর অপরাধ দমনের চূড়ান্ত দাওয়াই অভিভাবকদের সচেতনতা। প্রত্যেক মা-বাবাকে সন্তান সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কোথায় সময় কাটাচ্ছে, সে বিষয়ে মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে। অস্বাভাবিক কিছু নজরে এলেই তাকে কাউন্সিলিং করতে হবে। মা-বাবার তীক্ষ্ণ নজরদারি দরকার। তিনি বলেন, দিনে একবার হলেও পরিবারের সবাই এক টেবিলে বসে খাবার খেতে হবে। এতে ভাবের আদানপ্রদান হয়। সন্তানদের চাহিদা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়।
ভার্চুয়াল জগতের কিশোররা এতটাই বেপরোয়া যে, অপরাধ সংগঠনের আগে এরা নিজেদের ফেসবুক গ্রুপে স্ট্যাটাস দেয়। তুচ্ছ ঘটনায় এরা খুন করে বসে। সম্প্রতি আশুরার একটি ঘটনায়ই এদের বেপরোয়া আচরণের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
৩১ আগস্ট রাজধানীর লালবাগ কেল্লায় আশুরায় ঢোল বাজানো নিয়ে বিতর্কের জেরেই রনি হাসান নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২ সেপ্টেম্বর ৮ কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের সবার বয়স ১৮ বছরের নিচে। গত বছরও এদের হাতে খুন হয় কিশোর সিজান ওরফে বক্সার। বিপথগামী এসব কিশোরের বেশির ভাগই স্কুল ড্রপআউট। এরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমোতে নিজেদের মধ্যে কোনো অপরাধের আগে ভাববিনিময় করে থাকে।
সূত্র জানায়, দেশে বছরে কিশোর অপরাধের ঘটনায় ৫ শতাধিক মামলা হচ্ছে। সম্প্রতি মামলার সংখ্যা কিছুটা কমলেও বেড়েছে অপরাধের ধরন। প্রতিবছর হত্যা ও ধর্ষণ সংক্রান্ত ২ শতাধিক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। অজপাড়াগাঁয়েও এখন এদের বিস্তার। সূত্র বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের বেশির ভাগ সদস্যই পরিবার থেকে কোনো না কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন। এদের মধ্যে অনেকেই আবার মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়েও জড়াচ্ছে অপরাধে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ইন্সপেক্টর জুয়েল মিয়া যুগান্তরকে বলেন, এরা সংঘবদ্ধ হওয়ায় অনেকেই মনে করেন, এদের পেছনে কোনো গডফাদার বা প্রভাবশালী কেউ রয়েছে। ফলে কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। আর এ কারণেই পাড়া-মহল্লায় এদের তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে।
পিবিআইপ্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, গ্যাং কালচারের সদস্যরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে বেশি যোগাযোগ রক্ষা করে। কারও সঙ্গে ঝামেলা হলে এরা গ্রুপে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়ে দেয়। গোপন পরিকল্পনা এমনকি নির্দেশনাও দেয় সিক্রেট গ্রুপে।
এভাবেই এরা একে অপরের ওপর হামলা চালায়। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, পাশাপাশি প্রত্যেক মা-বাবাকে তার সন্তান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বখে যাওয়া সন্তানকে সুপথে আনার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
আর পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, কিছু কিশোরের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়গুলো যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ। অপরাধে জড়িয়ে পড়া কিশোরদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পাশাপাশি কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা তৈরিতে পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক সভা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কিশোর অপরাধ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি জরুরি।
ঢাকার যত কিশোর গ্যাং : রাজধানীতে অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে। ধানমণ্ডিতেই রয়েছে অন্তত তিনটি গ্রুপ- ‘নাইন এম এম’, ‘একে ৪৭’ ও ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপ। রায়েরবাজার এলাকায় সক্রিয় ‘স্টার বন্ড গ্রুপ’ ও ‘মোল্লা রাব্বি গ্রুপ’, মোহাম্মদপুরে ‘গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ’, ‘লাড়া দে’, ‘লেভেল হাই’, ‘দেখে ল-চিনে ল’, ‘কোপাইয়া দে গ্রুপ’। তেজগাঁওয়ে ‘মাঈনুদ্দিন গ্রুপ’, মিরপুর-১১তে ‘বিহারি রাসেল গ্যাং’, মিরপুর ১২ নম্বরে ‘বিচ্চু বাহিনী’, ‘পিচ্চি বাবু’ ও ‘সাইফুলের গ্যাং’, সি-ব্লকে ‘সাব্বির গ্যাং’, ডি-ব্লকে ‘বাবু-রাজন গ্যাং’, চ-ব্লকে ‘রিপন গ্যাং’, ধ-ব্লকে ‘মোবারক গ্যাং’।
কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে ‘নয়ন গ্যাং’, তুরাগে ‘তালাচাবি গ্যাং’, উত্তরায় ‘পাওয়ার বয়েজ’, ‘ডিসকো বয়েজ’, ‘বিগ বস’, ‘নাইন স্টার’ ও ‘নাইন এম এম বয়েজ’, ‘এনএনএস’, ‘এফএইচবি’, ‘জিইউ’, ‘ক্যাকরা’, ‘ডিএইচবি’, ‘ব্লাক রোজ’, ‘রনো’, ‘কেনাইন’, ‘ফিফটিন গ্যাং’, ‘ডিসকো বয়েস’, ‘পোঁটলা বাবু’, ‘সুজন ফাইটার’, ‘আলতাফ জিরো’, ‘ক্যাসল বয়েজ’, ‘ভাইপার’, ‘তুফান’, ‘থ্রি গোল গ্যাং’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া দক্ষিণখানে ‘শাহীন-রিপন গ্যাং’, উত্তরখানের বড়বাগের ‘নাজিমউদ্দিন গ্যাং’, আটিপাড়ার ‘শান্ত গ্যাং’, ‘মেহেদী গ্যাং’, খ্রিস্টানপাড়ার ‘সোলেমান গ্যাং’, ট্রান্সমিটার মোড়ের ‘রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং’।
হাজারীবাগে ‘বাংলা’ ও গেণ্ডারিয়ায় ‘লাভলেট’, বংশালে ‘জুম্মন গ্যাং’, মুগদায় ‘চান-জাদু’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টি’, ‘ভলিয়ম টু’ ও ‘ভাণ্ডারি গ্যাং’, চকবাজারে ‘টিকটক গ্যাং’, ‘পোঁটলা সিফাত গ্যাং’ উল্লেখযোগ্য।
গত দুই মাসে র্যাব ও পুলিশের অভিযানে কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২৪ আগস্ট রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ‘স্টার বন্ড গ্রুপের’ ১৭ সদস্যকে আটক করে ১ বছর করে সাজা দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাদের কাছ থেকে ইয়াবা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তবে ‘স্টারবন্ড গ্রুপের’ প্রধান সানা এখনও অধরা। রায়েরবাজারে ‘মোল্লা রাব্বি গ্রুপের’ বিরুদ্ধে খুন ও ছিনতাইয়ের অনেক অভিযোগ রয়েছে।
একই দিন পুরান ঢাকার বংশালে ‘জুম্মন গ্রুপের’ প্রধান জুম্মনসহ ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। এছাড়া ২৫ আগস্ট মুগদা থানার মাণ্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে চান-জাদু (জমজ ভাই) গ্রুপ, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভাণ্ডারি গ্রুপের ২৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন র্যাব-৩ এর ভ্রাম্যমাণ আদালত। ১০ আগস্ট মিরপুর-১ নম্বর থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ২৪ অপরাধীকে গ্রেফতার করে র্যাব-৪।
৭ আগস্ট রাতে র্যাব-২ কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, কলেজগেট, শিশুমেলা, শ্যামলী ও মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে ৪৬ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে ১১ জনকে রায়েরবাজারে ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করে র্যাব। এর আগে ২৮ জুলাই মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ‘লাড়া দে’ ও ‘লেভেল হাই’ গ্রুপের ২ সদস্যকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে ৮ জনই দুর্ধর্ষ। ২০ জুলাই র্যাব-১ এর একটি দল ফাস্ট হিলার বস গ্যাংয়ের ১৪ সদস্যকে গ্রেফতার করে।
১৫ জুলাই রাতে র্যাব-১ তুরাগের বাউনিয়া থেকে অস্ত্রসহ ‘নিউ নাইন স্টারের’ ১১ সদস্যকে আটক করে। ১১ জুলাই র্যাব-১ এর একটি দল কিশোর শুভ হত্যায় জড়িত গ্রুপের ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করে।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, অপরাধীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর পর তারা যখন জামিনে বেরিয়ে যায়, তখন আর আমাদের কিছু করার থাকে না।