মিন্নির জামিন শুনানিতে দুপক্ষের আইনজীবীদের তুমুল বাদানুবাদ

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে জামিন দেননি হাইকোর্ট। জামিন আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল দিতে চাইলে মিন্নির আইনজীবীরা তাতে সম্মত হননি। পরে আদালত জামিন আবেদন ফেরত দেন।

বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আবেদন ফেরত দেন।

এসময় দুপক্ষের আইনজীবদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মিন্নিকে রিফাত হত্যার মাস্টারমাইন্ড দাবি করেন। আর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেন, মিন্নি স্বামীকে বাঁচাতে প্রাণপন চেষ্টা করেছেন। অথচ তাকেই বানানো হলো স্বামী হত্যা মামলার আসামি। একপর্যায়ে জামিন আবেদন ফেরত নেন তার মিন্নির আইনজীবীরা।

আদালতে মিন্নির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অর্ধশতাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির শুনানি করেন।

এ সময় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর ও রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফও উপস্থিত ছিলেন।

বিকাল ৩টায় জামিনের শুনানি শুরু হয়। শুনানির শুরুতে মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না আদালতে বলেন, মাই লর্ড, আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি এ মামলার প্রধান সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী। স্বামীকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপনে চেষ্টা করেছেন তিনি। তিনি যদি এ ঘটনায় জড়িত থাকতেন তাহলে স্বামীকে বাঁচাতে ঝুঁকি নিতেন না। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস স্বামী হত্যায় তাকে বানানো হলো আসামি। গ্রেফতারের পর পুলিশের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মিন্নি। নারী ও অসুস্থ বিবেচনায় আমরা তার জামিন চাই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী নারী, শিশু ও বৃদ্ধা হলে জামিন পাওয়ার বিধান রয়েছে।

মিন্নিকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অমান্য করেছে দাবি করে মিন্নির আইনজীবী বলেন, পুলিশ মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিজের কাস্টডিতে নিয়ে গ্রেফতার দেখাল। এরপর তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হল। পুলিশ রিমান্ডে নেয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশনা মানা হয়নি। জেলগেট থাকতে তাকে পুলিশ লাইনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একজন ১৯ বছরের তরুণীকে পুলিশ লাইনে নিয়ে পুরুষ পুলিশ সদস্য দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতন করা হয়। পুলিশের এ ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

জেড আই খান পান্না আরও বলেন, বিচারিক আদালতে মিন্নির পক্ষে প্রথম দিন কোনো আইনজীবী ছিলেন না। একজন আইনজীবী নিয়োগ দিলেও তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদও প্রচারিত হয়।

এ সময় জেড আই খান পান্না কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ আদালতে উপস্থাপন করেন।

জেড আই খান পান্না আরও বলেন, একটি বিশেষ মহলকে বাঁচানোর জন্যই পুলিশ প্রশাসন উঠে পড়ে লেগেছে। মিন্নি যদি জামিন পান তাহলে তিনি পালিয়ে যাবেন না। কিন্তু এ মামলার প্রধান সাক্ষীকে সরিয়ে দিলে মামলার মূল আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। মিন্নিকে আসামি রাখায় মামলা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে।

এ সময় মিন্নির পক্ষে অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন শুনানিতে বলেন, দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে ঘটনা ঘটল। দেশবাসী সবার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে। অথচ কিছু লোককে রক্ষা করার জন্য মিন্নিকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনার ১৮ দিন পর সাক্ষীকে আসামিকে করা হলো। আমরা নারী ও অসুস্থ বিবেচনায় তাঁর জামিন চাই।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির উঠে দাঁড়ান। তিনি জামিনের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।

এ সময় আদালত জানতে চান, আপনি কী বক্তব্য রাখবেন? কী আছে? জবাবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, ভিডিও আছে, অনেক কিছুই আছে। আমি আপনাকে জানাচ্ছি। মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের দীর্ঘদিনের প্রণয় ছিল। রিফাতের আগে মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের বিয়ে হয়। সেই বিয়ের তথ্য গোপন করেই মিন্নি রিফাতের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। নয়ন বন্ড যখন জেলে থাকে তখন মিন্নি তথ্য গোপন করে রিফাত শরীফকে বিয়ে করেন। সেই কাবিননামা আমাদের কাছে রয়েছে। শুধুই তাই নয়, নয়ন বন্ড জেল থেকে বের হয়ে আসার পর এক সঙ্গে দুটি সম্পর্ক বজায় রাখেন মিন্নি। স্বামীর পাশাপশি নয়ন বন্ডের সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক করতেন মিন্নি। কলেজে যাওয়ার নাম করে মিন্নি নয়ন বন্ডের বাসায় গিয়ে মেলামেশা করতেন। এ বিষয়গুলো মিন্নি নিজেই স্বীকার করেছেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। নিম্ন আদালতে মিন্নির রিমান্ড আবেদনে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আরও জানান, দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখায় এক সময় নয়ন বন্ড ও রিফাতের মধ্যে ঝামেলা তৈরি হয়। পরে মিন্নি ও নয়ন বন্ড মিলে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। হত্যার উদ্দেশ্যে রিফাতকে কলেজে নিয়ে যান মিন্নি। এরপর তাঁর সামনে রিফাতকে ধরে নিয়ে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে নয়ন বন্ড কোপাতে থাকলে মিন্নি বাঁচানোর অভিনয় করেন।

তিনি বলেন, রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার আগে এবং পরে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির কথোপকথনের রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে। সেই রেকর্ডে বলা আছে, তাঁরা রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। মিন্নি ও নয়ন বন্ডের ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে কথোপকথনের রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে।

এরপর মিন্নির পক্ষের আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতে বলেন, এসব ডকুমেন্ট ও ভিডিও তৈরি করা যায়। ভেরিফায়েড কি না, তা দেখতে হবে। এসব তো মামলার মেরিটের অংশ নয়। আপনি মূল জায়গায় আসেন। এসময় দুপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাদানুবাদ হয়।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, আপনারা পত্রিকার সংবাদ উপস্থাপন করেছেন। তা কি মামলার নথি? প্লিজ, সাইড টক করবেন না। কোনো কিছু কি জোরপূর্বক আদায় করবেন?

এ সময় আদালত বলেন, কেউ কোনো কিছুই জোরপূর্বক আদায় করতে পারবে না। ফেসবুকের আইডি সঠিক কি না, তার তো সার্টিফায়েড লাগবে।

এসময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, মাই লর্ড, ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রিফাত শরীফকে যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন মিন্নির আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছে। কেননা কলেজের ফটকে তিনি একবার এসে আবার ভেতরে যান। আবার ফিরে আসেন। রিফাত শরীফকে যখন মারার জন্য ধরে নিয়ে যাচ্ছে তিনি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। যখন কোপানো শুরু করল তখন বাঁচানোর নামে অভিনয় করেছেন। রিফাতকে কোপানোর সময় বাঁচাতে এলো অথচ মিন্নির গাঁয়ে একটু নখের আচড়ও লাগল না। ঘটনার আগে পরে বহুবার নয়ন বন্ড এবং মিন্নির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে বলেও জানান আইনজীবী।

মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, প্রকৃতপক্ষে মিন্নি ছিলেন রিফাত হত্যার মাস্টারমাইন্ড। মিন্নি নয়ন বন্ডকে বিয়ের তথ্য গোপন করে দুই মাস পর রিফাতকে বিয়ে করেন। বিচারিক আদালত মিন্নির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির স্বীকারোক্তি, নয়ন বন্ডের সঙ্গে বিয়ের কাবিননামা, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে জামিন নামঞ্জুর করেন।

২৬ জুন রিফাতকে বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। পর দিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল মিন্নিকে। পরে মিন্নির শ্বশুর তার ছেলের হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করলে আলোচনা নতুন দিকে মোড় নেয়। ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পর দিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক মিন্নিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।

রিমান্ডের তৃতীয় দিন শেষে মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে জানায় পুলিশ। বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত এবং জেলা ও দায়েরা জজ আদালতে মিন্নির জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন মিন্নি।

Please follow and like us:
fb-share-icon
Tweet 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social media & sharing icons powered by UltimatelySocial
error

Enjoy this blog? Please spread the word :)