ঈদের সামাজিক গুরুত্ব
দ্বিতীয় হিজরীতে রমজানের রোজা ফরজ করা হয়। দীর্ঘ একমাস রোজা রাখার পর মুসলমানরা প্রথম ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। সে হিসেবে এবারের ঈদ হচ্ছে ১৪৩৯তম।
ঈদুল ফিতর উদযাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। এ মাসে ব্যবসা কেমন হয়েছে, কেমন সুযোগ-সুবিধা ছিলো তা ধর্তব্য নয়। মূল বিষয় হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করে, তা দ্বারা জান্নাতের হকদার হওয়া। তাই রমজানে যার আমলে পরিবর্তন এসেছে সেই সৌভাগ্যবান।
অফুরন্ত নেয়ামত, আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুযোগ পেয়েও যারা কাজে লাগাতে পারেনি তারা হতভাগা। নির্দিষ্ট সময় চলার পর বস্তুর সার্ভিসিং করাতে হয়। তা না হলে পর্যায়ক্রমে দুর্বল হতে হতে এক সময় তা বন্ধ হয়ে যায়। মানুষেরও সার্ভিসিং করার প্রয়োজন হয়। তা না হলে মানুষ থেকে মানবীয় গুণাবলী হারিয়ে যায়। পশুত্ব ছড়াতে থাকে সমাজে। তাই যারা রোজা রেখেছি আমাদেরকে রমজানের শিক্ষা ধরে রাখতে হবে। সারা বছর একে কাজে লাগিয়ে সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতিকে দূর করতে হবে।
প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠির নির্দিষ্ট কিছু উৎসব রয়েছে। ওই দিনগুলোতে নিজেদের মতো করে আমোদ-ফূর্তি, চিত্তবিনোদন করে। খেয়ে ও পরে থাকে নিজের সাধ্যের সর্বোৎকৃষ্ট জিনিস। ভাবগাম্ভির্যপূর্ণ, সুনসান নীরব পরিবেশ ভেঙ্গে, মাঝে মধ্যে বিনোদন ও কোলাহলের দিকে ছুটে চলা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত। কেমন যেন সৃষ্টিকর্তা মানুষের ভেতর এ রকম একটা ভাব দিয়ে রেখেছেন। এ জন্য পৃথিবীর সকল মানব গোষ্ঠির উৎসব রয়েছে। এমন কোনো জাতি গোষ্ঠি পাওয়া যাবে না, যাদের চিত্তবিনোদনের জন্য উৎসব নেই; ধর্মীয় ইবাদত-বন্দেগীই যাদের কাজ। হাদিস থেকেও এর প্রমাণ মেলে। নবী করীম (সা.) বলেন, প্রত্যেক জাতির চিত্তবিনোদনের জন্য ঈদ বা উৎসব রয়েছে। আমাদের (চিত্তবিনোদনের) জন্য রয়েছে এই ঈদ। (ফাতহুল বারী, শরহে সহীহিল বুখারী)
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন ইসলামকে। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। তাই নির্মল চিত্তবিনোদনের ইসলামী রূপরেখা রয়েছে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে দুটি দিন ধার্য করে দিয়েছে, যেখানে তারা চিত্তবিনোদন করতে পারে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ইসলামে এই দুই দিন ছাড়া উৎসব হিসেবে যে দিবস পালন করা হবে তা হবে কুসংস্কারের অন্তর্ভূক্ত। যার ধর্মীয় কোনো ভিত্তি নেই। এর অর্থ কখনো এটা নয়, সারা বছরে এই দু,দিনের মধ্যেই মুসলমানের বিনোদন সীমাবদ্ধ। বরং চিত্তবিনোদন হতে পারে যেকোনো দিনে। মুসলমানদের সামাজিক জীবন মূলত শুরু হয়েছে হিজরতের পর। রাসূল (সা.) মদীনায় হিজরতের পর দেখতে পেলেন, মদীনাবাসী দু’দিন উৎসব পালন করে। রাসূল (সা.) তাদের উৎসব সম্পর্কে জানতে চেয়ে বলেন, এই উৎসব কোথা থেকে এলো? মদীনাবাসী উত্তর দিলো, জাহেলি যুগে এই দু’দিন আমরা উৎসব পালন করেছি, সেই ধারাবাহিকতায়। মূলত ওই দুটি উৎসব ছিলো পারসিক সভ্যতার ধ্যান-ধারণা থেকে। তাই রাসূল (সা.) ওগুলোকে নিষেধ করে দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে এর পরিবর্তে তার চেয়ে উত্তম দুটি উৎসব দিয়েছেন। ইদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। (সুনানে আবু দাউদ)
কোনো জাতি-গোষ্ঠির উৎসব, তাদের ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস ও সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। পূর্বোক্ত হাদিসে নবী করীম (সা.) কর্তৃক মদীনাবাসীর দুটি উৎসবকে নিষিদ্ধের কারণ এটাই ছিলো। কারণ তারা এত দিন যে উৎসব পালন করে আসছিলো, তাতে জাহেলি যুগের সংস্কৃতি ও আকীদা-বিশ্বাসের ছাপ ছিলো। এ জন্য রাসূল (সা.) জাহেলি যুগের ওই উৎসবকে পরিবর্তন করে, তদ্বস্থলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে অনুমোদন দিয়েছেন। ঈদের উৎসবে ইসলামের আকীদা, সভ্যতা-সংস্কৃতির চিত্র ফোটে ওঠে। শাওয়ালের চাঁদ দেখে সারা বিশ্বের মুসলিম ধনী-গরিব সকলে যখন এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায়, এর দ্বারা মূলত মুসলিম উম্মাহর সাংস্কৃতিক ঐক্য ও ইসলামের সাম্য নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এটা এমন এক সৌন্দর্য যা দেখে অন্যরা হতবাক হয়ে যায়।
রমজানের শেষ রাত খুবই ফজিলতপূর্ণ। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, রমজান মাসের শেষ রজনীতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার জন্য ক্ষমা ও দানের ফয়সালা করেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেন, ওই রাতটিই কী শবে কদর? রাসীল (সা.) বলেন, না। কিন্তু সিস্টেম হচ্ছে কর্মচারী যখন কাজ বুঝিয়ে দেয় তখন তার পাওনাও পরিশোধ করে দেয়া হয়। (মুসনাদে আহমদ) রাসূল (সা.) বুঝাতে চেয়েছেন, রোজাদারের আমল এই দিন শেষ হয়। আর তখন আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা মাফিক যার যে প্রতিদান তা দেয়া হয়। তাই ঈদের রাতে ইবাদত, তওবা, ইস্তেগফারে মশগুল থাকা চাই। এ প্রসঙ্গে ‘আল মাওসূয়াতুল ফিকহিয়া আল কুয়েতিয়া’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মুস্তাহাব হচ্ছে, উভয় ঈদের রাতে আল্লাহর ইবাদত, জিকির, তেলাওয়াত ও তাসবিহ-তাহলিলে মশগুল থাকা। রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় সওয়াব লাভের আশায় রাত্রি জাগরণ করবে, তার অন্তর ওই সময় জীবিত থাকবে যখন অন্য সকল অন্তর মরে যাবে।’ উক্ত হাদিসটি মুহাদ্দিসগণের মতে সনদগতভাবে দুর্বল। তবে এ রকম আমলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিসও দলীল হতে পারে।
ঈদে অসহায়ের মুখে হাসি ফোটানো:
ঈদের আগে ও পরে অনেক করণীয় আছে। প্রথম করণীয় হচ্ছে, সমাজের গরীব দুঃখীদের প্রতি খেয়াল রাখা। রমজানের অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, অসহায় মানুষের ক্ষুধার যাতনা ধনীর উপলব্ধিতে আনা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করে তা শিখা হয়। তাই ঈদুল ফিতরের খুশিতে সবকিছু ভুলে না যাওয়া। এ জন্যে ইসলাম ‘সদকাতুল ফিতর’ নামক একটি স্বতন্ত্র বিধান দিয়ে রেখেছে। জাকাতের নেসাব পরিমাণ মালের মালিক ব্যক্তি, নিজের ও অপ্রাপ্ত সন্তানাদির সদকাতুল ফিতর আদায় করবে। যারা জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত তারা এই সদকা খেতে পারবে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে সদকাতুল ফিতরের হেকমত বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) সদকাতুল ফিতরের বিধান দিয়েছেন, রোজার ত্রুটি, বিচ্যুতি পূরণ ও গরিব মিসকিনদের খাবারের বন্দোবস্ত করার জন্য। (আবু দাউদ) হাদীসের মর্ম স্পষ্ট যে, সদকাতুল ফিতর মূলত খুশির এ দিনে গরিব-মিসকিনদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তাছাড়াও রমজানে জাকাত আদায় ও মৃত আত্মীয়দের তরফ থেকে বেশি বেশি দানের মাধ্যমে গরিব-দুঃখীর পাশে আমরা দাঁড়াতে পারি।
ঈদে নির্মল চিত্তবিনোদনের আয়োজন থাকা:
ঈদের দিনটাকে নীরবে পার না করে, কিছু চিত্তবিনোদনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা চাই। কারণ ঈদের দিনে এ রকম আয়োজনের বর্ণনা হাদিসেও এসেছে। কোনো এক ঈদে দুজন বালিকা হজরত আয়শা (রা.) এর ঘরে এসে গান গাচ্ছিলো। রাসূল (সা.) শুয়ে শুয়ে তাদের দৃশ্য দেখছিলেন। ইতোমধ্যে হজরত আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করেন। মেয়ে হজরত আয়শা (রা.)-কে আবু বকর ধমকালেন যে, রাসূলের ঘরে শয়তানের বাদ্য? তখন নবী করীম (সা.) উঠে এসে হজরত আবু বকর (রা.)-কে বললেন, তাদেরকে সুযোগ দাও। তাছাড়া ঈদের দিনে হাবশিদের বর্শা নিয়ে খেলা দেখানো ও যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল দেখানোর আয়োজনও থাকতো। রাসূল (সা.) আয়শা (রা.)-কে নিয়ে তা দেখায় অংশগ্রহণ করতেন। এ সকল হাদিস প্রমাণ করে ইদের দিনে চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন আয়োজন থাকতে পারে। যেখানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অংশগ্রহণ করা যায়।
ঈদের দিন কবর জিয়ারত করা:
ঈদের দিনে কবর জিয়ারত করা। কারণ উৎসবের আমেজ যেন আমাদের আখেরাতের ব্যাপারে বেখবর করে না দেয়। বহু হাদিসে কবর জিয়ারতের কথা এসেছে। মুসলিম শরীফের এক হাদিসে এসেছে নবী করীম (সা.) বলেন, আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত থেকে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমাদেরকে কবর জিয়ারতের অনুমতি দিচ্ছি। কারণ, কবর জিয়ারত আখেরাতের কথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে কোনো কোনো ফকিহ এটাকে অপছন্দ করেছেন। তাই জরুরি বা রসম হয়ে গেলে না করা উচিত।
আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য যাওয়া:
পূর্বে হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজরত আবু বকর (রা.) ঈদের দিন হজরত আয়শা (রা.) এর ঘরে প্রবেশ করে দুজন বাচ্চা মেয়েকে গান গাওয়ার কারণে ধমক দিয়েছিলেন। হজরত আবু বকর (রা.) মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও ঈদের বেড়ানোর জন্য। তাছাড়া হাদিসে এসেছে নবী করীম (সা.) ঈদের নামাজে এক রাস্তা দিয়ে যেতেন আর ফিরে আসতেন অন্য পথে। হাদিস বিশারদগণের দাবী হচ্ছে, রাসূল (সা.) এ কাজ করতেন ওই পথের আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও খোজ খবর নেয়ার জন্য। তবে এই ব্যাখ্যা দ্বারা একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, তাহলে আমাদের যাদের অন্য পথে আত্মীয় নেই আমরা কী ওই কাজ করবো না? আসলে এখানে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় হওয়া জরুরি নয় বরং প্রতিবেশী হিসেবেও কারো খোজ খবর নেয়া আমাদের দায়িত্ব।
হাদিস শরীফে রাসূল (সা.) এর ঈদের নামাজ ও ঈদগাহ সংক্রান্ত আমলের বর্ণনা এসেছে। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ঈদগাহে গিয়ে প্রথমে নামাজ আদায় করতেন। তারপর মুসল্লিদের দিকে ফিরে খুতবা দিতেন। খুতবায় মুসলমানদের জন্য নসীহত ও বিভিন্ন বিষয়ে ওসিয়ত থাকতো। এরপর কোনো মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করার প্রয়োজন হলে সেখান থেকে তিনি পাঠিয়ে দিতেন। তারপর মাঠ থেকে ফিরে আসতেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
রাসূল (সা.) এর কর্মপন্থা দ্বারা বুঝা যায়, উৎসবের অযুহাতে দ্বীনের কাজ বন্ধ রাখা যায় না। মুসলমানের কাছে দ্বীনের কাজ আঞ্জাম দেয়ার মধ্যেই প্রকৃত আনন্দ।