স্বাস্থ্য বিভাগে দেশব্যাপি আলোচিত আফজালের মত ফজলুর প্রোফাইল!
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে স্বাস্থ্য বিভাগের যন্ত্রাংশ ক্রয়ের নামে ১৮ কোটি টাকা গায়েবের ঘটনায় নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ সাতক্ষীরার নেতৃবৃন্দ গত ২৪ এপ্রিল সিভিল সার্জন অফিসে পৌছে ঘেরাওকালে দুদকের অনুসন্ধানী দল পৌছালে স্টোরকিপার একেএম ফজলুল হক পালিয়ে যান। দুদক ফজলুল হককে না পেয়ে গণমাধ্যমকে বিষয়টি পরিস্কার করে জানান। একই সাথে তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সিভিল সার্জন জানান তাকে কৈফিয়ৎ তলব করা হবে। যথারীতি ওইদিনই তাকে কৈফিয়ৎ তলব করা হয়। সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম উক্ত তৈফিয়ৎ তলব করে ৩দিনের মধ্যে জবাব দাখিল করার নির্দেশ দেন। সোমবার স্টোরকিপার ফজলুল হক তার লিখিত জবাব দাখিল করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট অফিসের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়।
জবাবে বলা হয়েছে, তিনি অফিসিয়াল কাজে দ্রুত বাইরে যান। একই সাথে বাইরে যাওয়ার সময় তার ব্যক্তিগত সেলফোনটি চার্জ না থাকায় অফিসে রেখে যান। এসময় রিং বাজলেও রিসিভ করা সম্ভব হয়নি। ফলে অনিচ্ছাকৃত প্রথম এই ত্রুটির জন্য তিনি সিভিল সার্জনের নিকট ক্ষমা চেয়েছেন বলে সূত্রগুলো জানায়।
এ ব্যাপারে রাতে সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি শুনেছি ফজলুল হক লিখিত জবাব দাখিল করেছেন কিন্তু অফিসিয়াল ডাক ফাইল হাতে না আসায় আমি দেখতে পারেনি। তবে মঙ্গলবার ফাইলটি দেখে পূর্ণাঙ্গ মতামত জানাতে পারবো।
অভিযোগের শেষ নেই ফজলুল হকের বিরুদ্ধে: এদিকে বিগত ১৬ সালে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য বরাদ্দকৃত সাড়ে ১১ কোটি টাকার ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম লুটপাটের অভিযোগ উঠে স্টোরকিপাল একেএম ফজলুল হকের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তৎকালিন সিভিল সার্জন ডা. উৎপল কুমার দেবনাথ তাকে ওই বছরের ৯ জুন সাময়িক বরখাস্ত করেন।
সংশ্লিষ্ট অফিসের একাধিক সূত্র জানান, ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য সাত কোটি ৯৯ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৫ টাকা মূল্যের ঔষধ, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা ও সার্জিকাল যন্ত্রপাতি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া ও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম শুরু না করতে পারায় ওই মালামাল ফেরৎ পাঠানোর জন্য সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই ৫৪৯ নং স্মারকে ওইসব মালামাল ফেরৎ না পাঠিয়ে সদর হাসপাতাল, সাতটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে ও বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপসচীব আব্দুল মালেক সাতক্ষীরা সিভিল সার্জনকে একটি চিঠি দেন।
নির্দেশ পেয়ে নিয়ম অনুযায়ি সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সালেহ আহম্মেদ ওইসব মালামাল চাহিদাপত্র দিয়ে বুঝে নিয়ে সিভিল সার্জন অফিসের স্টোরকিপার একেএম ফজলুল হকের কাছে তাৎক্ষণিক হস্তান্তর করেন। ওই বছরের ১৪ জানুয়ারি সিভিল সার্জন ডা. সালেহ আহম্মেদ অন্যত্র বদলী হয়ে যান। সেখানে নতুন সিভিল সার্জন হিসাবে যোগদান করেন ডা. উৎপল কুমার দেবনাথ।
ডা. উৎপল কুমার দেবনাথ যোগদান করার পরপরই আট কোটি টাকা ও সাড়ে তিন কোটি টাকার মালামাল সম্পর্কিত কাগজপত্রে অনিয়ম ও দূর্ণীতি লক্ষ্য করেন। এক পর্যায়ে দুর্নীতির বিষয়টি তদন্তের জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন তিনি। কমিটির প্রধান হিসেবে ডা. আবুল হোসেন ছাড়াও সদর হাসপাতালের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. আসাদুজ্জামান এবং সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. আরিফুজ্জামানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তদন্ত কমিটির সদস্যরা স্টোরকিপার ফজলুল হকের কাছে আট কোটি টাকার মালামাল সরবরাহ ও বন্টন সম্পর্কিত কাগজপত্র দেখতে চান। তিনি এ কিমিটির কাছে কোন কাগজপত্র দেখাতে রাজি হননি।
একপর্যায়ে বিষয়টি সিভিল সার্জনকে অবহিত করলে তার পরামর্শ অনুযায়ি ফজলুল হককে ফের চিঠি দিয়ে তার বক্তব্য লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়। ফজলুল হক তার জবাবে কাগজপত্র সাবেক স্টোরকিপার আব্দুর রউফ ও মহসিন আলীর কাছ আছে বলে জানিয়ে দেন। সে অনুযায়ি তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে আব্দুর রউফ ও মহসিন আলীকে পৃথকভাবে জবাব দেওয়ার জন্য বলা হয়।
বিষয়টি নিয়ে আব্দুর রউফ ও মহসিন আলী তদন্ত কমিটির কাছে পৃথক ভাবে লিখিত জবাব দেন। জবাবে তারা দায়িত্ব হস্তান্তরকালে সকল কাগজপত্র পরবর্তী স্টোরকিপার ফজলুল হককে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন।
সূত্র আরও জানান, তদন্ত কমিটি বিগত ১৬ সালের ১৯ মে সিভিল সার্জনের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহে তারা ব্যর্থ হয়েছেন মর্মে উল্লেখ করেন। একই সাথে সিভিল সার্জেনের নির্দেশিত ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার ঔষধ, গাজ-ব্যান্ডেজ (এমএসআর) ও প্রায় দু’কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ঔষধ (সিএমএসডি ও ইডিসিএল) এর কাগজপত্র ফজলুল হকের কাছ থেকে সংগ্রহে ব্যর্থ হন বলে প্রতিবেদনে উলে¬খ করেন তদন্ত কমিটি।
এ ছাড়া ফজলুল হকের বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিসে দায়িত্ব পালনকালে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা আত্মসাতের কথা উল্লেখ করে দুদকের মামলায় চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন চাকুরিচ্যুত হন ও ফজলুল হক কিস্তিতে ওই টাকা ফেরৎ দেওয়ার শর্তে নিজের চাকরি বাঁচান বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লে¬খ করা হয়।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর কিপার ফজলুল হকের বিরুদ্ধে সরকারি ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম লুটপাটের মাধ্যমে সাড়ে ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হওয়ায় সিভিল সার্জন ডাঃ উৎপল কুমার দেবনাথ তাকে চাকুরি থেকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করেন।
এরপর নানা অজুহাত উচ্চ আদালতের নির্দেশনাসহ বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে তিনি আবারো সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসে যোগদান করেন। সর্বশেষ চলতি বছরে দূর্ণীতিতে তিনি নতুন চমক নিয়ে এসেছেন সাতক্ষীরাসহ দেশবাসীর কাছে। বরাদ্দের ১৮ কোটি টাকার পুরোটাই হজম করে ফেলেছেন। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং এখন কিছু কিছু স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ তিনি আনছেন। যা সর্বশেষ ৩০ অক্টোবর ২০১৮ সালে এসব মালামাল খাতা কলমে গ্রহণ করেছেন বলে দেখা যায়। তবে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর এসব মালামাল গ্রহণ করার পর এখন আসছে কেন এমন প্রশ্নের কোন জবাব নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।
আর এবারের দুর্ণীতিতে তার সঙ্গী হিসেবে আছেন, সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান, আছেন আরেক সহযোগি হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। আর পর্দার পেছনে কারা আছে তা জানতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছেন দুদক এর খুলনা বিভাগী অফিসের কর্মকর্তারা।
তবে গতকাল সিভিল সার্জন অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, একেএম ফজলুল হকের সাথে যে যে সিভিল সার্জন চাকুরি করেছেন তাদের অধিকাংশই সুষ্ঠুভাবে বাড়িতে ফিরতে পারেননি, অনেকের চাকরি চলে গেছে, আবার অনেকের চাকুরি শেষে সরকারি টাকা ফেরত দিতে হয়েছে। অনেকের অবসরের টাকা তুলতে পারেননি। একেএম ফজলুল হক স্বাস্থ্য বিভাগের সারা দেশের মধ্যে আরেক আফজাল হিসেবে ইতোমধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে বলেই মন্তব্য করেন অনেকেই।